অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া যত অগ্রসর হয়েছে, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন পরিসরে ততই শোনা গিয়েছে একটি কথা: এ-বার কোনও ‘ওয়েভ’ নেই। অর্থাৎ, কোনও একটি বিষয় নিয়ে দেশ জুড়ে আবেগের তরঙ্গ ওঠেনি, কোনও এক জন নায়ক বা নায়িকা জনচিত্তে উন্মাদনার লহর তুলতে পারেননি। দুনিয়ার বহু দেশেই এই বিষয়ে আলোচনার কোনও কারণ ঘটত না, কারণ সেখানে ভোটের সময় আবেগ বা উন্মাদনার প্রশ্ন ওঠে না, জনজীবনের আর পাঁচটা নিয়মিত কর্মকাণ্ডের মতোই নির্বাচনও আসে এবং যায়, নাগরিকরা নিত্যকর্মপদ্ধতি হিসাবেই ভোট দেন বা দেন না। কিন্তু ভারতে, বিশেষত সত্তরের দশকের গোড়ায় ‘গরিবি হটাও’ আহ্বানের প্রেক্ষাপটে আয়োজিত লোকসভা ভোটের সময় থেকে, বার বার বিভিন্ন ধরনের নির্বাচনী তরঙ্গ দেখা গিয়েছে। গত দশ বছরে এই বিষয়ে কার্যত একচেটিয়া দাপটে যিনি নির্বাচনী সমুদ্র শাসন করেছেন তাঁর নাম নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪ সালের আবির্ভাব পর্বে এবং ২০১৯-এর প্রত্যাবর্তনী অভিযানে সুপরিকল্পিত আবেগ-উন্মাদনার লহর তুলেই তাঁর বিপুল সাফল্য। তৃতীয় দফার আদিপর্বেও, বিশেষত জানুয়ারির শেষে অযোধ্যার মহাসমারোহের কল্যাণে, নানা মহল থেকে ধ্বনিত হয়েছিল উচ্চকিত পূর্বাভাস: বিপুল তরঙ্গ রে! নির্বাচনের প্রায় শেষ পর্বে পৌঁছে বলা চলে— সেই ধারণার সঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতা মেলেনি। ‘মোদী কি গারন্টী’র প্রলোভন অথবা ‘মঙ্গলসূত্র’ বেহাত হয়ে যাওয়ার ভয়, কোনও কিছু দেখিয়েই কোনও দৃশ্যমান উন্মাদনা সৃষ্টি করা যায়নি।
এই বাস্তবের অর্থ কী, শেষ অবধি ভোটের ফলাফলে তার কী প্রতিফলন ঘটতে চলেছে, সেই বিষয়ে কোনও জল্পনার প্রশ্ন নেই। এ দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া দেখে জনাদেশ সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া সততই কঠিন, কোনও সুস্পষ্ট বা প্রকট ‘হাওয়া’ না থাকলে স্বভাবতই তা বহুগুণ বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু পরিণাম যা-ই হোক না কেন, শাসকের প্রচণ্ড চেষ্টা সত্ত্বেও যে নির্বাচনকে ঘিরে আবেগ বা উন্মাদনার কোনও উচ্ছ্বাস তৈরি হয়নি, তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। উচ্ছ্বাস বা উন্মাদনা স্বভাবত যুক্তি ও বিবেচনার প্রতিকূল। দেশ জুড়ে ভোটদাতারা বিপুল তরঙ্গে বেসামাল হয়ে পড়লে জনাদেশের ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যায়, কারণ তখন যথেষ্ট বিচার-বিশ্লেষণের ভিত্তিতে জনমত গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে না। ঠিক এই কারণেই দুনিয়ার নানা অঞ্চলে ‘পপুলিস্ট’ বা জনবাদী নায়কনায়িকারা জনসাধারণকে কোনও না কোনও আবেগের প্লাবনে ভাসিয়ে দিতে এত উৎসাহী হয়ে থাকেন, মানুষ ঠান্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করে এবং বাস্তবকে খতিয়ে দেখে মতামত দিতে শুরু করলে তাঁদের জনপ্রিয়তা ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। জনবাদী আবেগের সংক্রমণ থেকে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যরক্ষা এখন দুনিয়া জুড়েই একটি বড় কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভোটের তরঙ্গ যত কম হবে, গণতন্ত্রের পক্ষে ততই মঙ্গল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ভারতের মতো দেশে, যেখানে সমাজের বাস্তবতা এবং সমস্যাগুলি বহুধাবিভক্ত, বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বর্গের নাগরিকের স্বার্থ ও ধ্যানধারণায় বিস্তর পার্থক্য, সেখানে কোনও একটি বিশেষ তরঙ্গ না থাকলে জনাদেশের সংহতি থাকবে কী করে? যিনি যেখানে দাঁড়িয়ে, তিনি সেই অনুসারে প্রতিনিধি বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত স্থির করলে সামগ্রিক পরিসরে অস্থিরতার আশঙ্কা থাকবে না কি? এই প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজার একমাত্র উপায় যথার্থ গণতন্ত্রের অনুশীলন। বিভিন্ন মত, বিভিন্ন স্বার্থ, বিভিন্ন ধারণার পারস্পরিক কথোপকথনের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র গড়ে তোলা এবং নিরন্তর তার পরিমার্জন সাধন করে চলাই গণতন্ত্রের ধর্ম। সর্বগ্রাসী আবেগের ‘ওয়েভ’ সেই ধর্ম পালনে দুস্তর বাধা সৃষ্টি করে। ভারতীয় নির্বাচন যদি সত্যই নিস্তরঙ্গ হয়ে ওঠে, জনবাদী মহানায়ক বা মহানায়িকারা বিমর্ষ হতে পারেন, কিন্তু তার ফলে ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত শক্ত হবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)