Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
Indian Judiciary

প্রশ্নাতীত ক্ষমতা

আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার এই প্রবণতাটিও কি একই ভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী নয়?

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২২ ০৫:১৭
Share: Save:

গণতন্ত্রের আব্রুরক্ষায় ভারতের সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা যে সুপ্রিম কোর্ট, তাতে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। সেই কারণেই, প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট (পিএমএলএ)-এর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে, আদালতের উপর পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রেখেই কিছু প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। বিচারপতি খানউইলকরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ শীর্ষ আদালতেরই আগেকার রায় নাকচ করে জানাল যে, ২০০২ সালের পিএমএল নামক আইনটির বিচারাধীন বিষয়গুলি অসাংবিধানিক নয়। আদালত জানাল, এই আইনের আওতায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট যদি কাউকে গ্রেফতার করে, তবে যিনি গ্রেফতার হলেন, তাঁর জানতে চাওয়ার অধিকার নেই যে, কেন তাঁকে গ্রেফতার করা হল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার দায়ও অভিযুক্তের উপরই বর্তাবে। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দর্শন হল, যত ক্ষণ না কেউ দোষী প্রমাণিত হন, তত ক্ষণ তাঁকে নির্দোষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের অবস্থানটি কি এই দর্শনের পরিপন্থী নয়? এত দিন দু’টি বিরল ক্ষেত্রে— সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ও শিশুদের উপর যৌন নিপীড়নের ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমটি আইনত সিদ্ধ ছিল। অনুমান করা চলে যে, মানি লন্ডারিং, অর্থাৎ কালো টাকা সাদা করার প্রক্রিয়াকেও আদালত সমতুল্য অপরাধ হিসেবে গ্রাহ্য করেছে। যে কথাটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ, তা হল, আদালত জানিয়েছে যে, সংসদ চাইলে আইনের মৌলিক কাঠামো বা অবস্থানেরও পরিবর্তন সাধন করতে পারে। এই রায় সংবিধানের সর্বাগ্রগণ্যতা ও সার্বভৌমত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করবে না কি?

মানি লন্ডারিং যে একটি গুরুতর অপরাধ, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। শুধু অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই নয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও এই অপরাধ রোধ করার জন্য কঠোরতা বেড়েছে গত দুই দশকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই অপরাধ ঠেকানোর জন্য সংবিধানের মৌলিক ভিত্তিগত দর্শনের পরিপন্থী অবস্থান গ্রহণের পক্ষে সুযুক্তি আছে কি? শীর্ষ আদালতের আগের রায় এই আইনকে ‘আর্বিট্রারি’ বা ‘যথেচ্ছ’ আখ্যা দিয়েছিল। এই রায়ে শীর্ষ আদালত সেই অবস্থানের বিপ্রতীপ মত প্রকাশ করল কেন, তার ব্যাখ্যা স্পষ্ট নয়। বর্তমান সরকারের শাসনকালে— বিশেষত দ্বিতীয় দফায়— পিএমএলএ এবং ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট বা ফেমা-র যে দৃশ্যত রাজনৈতিক ব্যবহার ক্রমবর্ধমান, আদালতের রায়ে কি সেই প্রবণতাই বৈধতার স্বীকৃতি পেল? সংসদে কেন্দ্রীয় অর্থ প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধরির পেশ করা পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে, ইউপিএ আমলের তুলনায় তো বটেই, এনডিএ-র প্রথম তিন বছরের তুলনায় দ্বিতীয় দফায় এই দুই আইনের অধীনে ইডি-র কাছে দায়ের করা মামলার সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ।

রাষ্ট্রের হাতে যথেচ্ছ ক্ষমতা পুঞ্জীভূত করার এই প্রবণতাটি অবশ্য শুধু বিজেপির নয়। পিএমএলএ তৈরি হয়েছিল অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে; কিন্তু আজ যে কংগ্রেস এই আইনটির দানবিক রূপ ও দমনশক্তির বিরুদ্ধে উদারবাদী অবস্থান গ্রহণ করছে, তার দশ বছরের শাসনকালে আইনটি কিন্তু প্রত্যাহৃত হয়নি, বরং কঠোরতর হয়েছিল। সংবিধানের ভিত্তিগত দর্শনকে অস্বীকার করে নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করা থেকে রাজনৈতিক দলগুলি স্বেচ্ছায় নিবৃত্ত থাকবে, ভারতে তেমন আশা করার অবকাশ নেই। সেই কারণেই নাগরিক সমাজ সুপ্রিম কোর্টের উপর আরও বেশি নির্ভরশীল। সেই ভরসার কারণও বিলক্ষণ রয়েছে। অতি সম্প্রতি মহম্মদ জ়ুবেরের জামিন প্রসঙ্গে শীর্ষ আদালত ব্যক্তিস্বাধীনতার অনতিক্রম্যতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। আইনকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করার এই প্রবণতাটিও কি একই ভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থী নয়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Judiciary PMLA Supreme Court India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE