তোমার মন নাই, পুলিশ?” আজকের কোনও গদ্যকারের কলমে যদি এমন একটি প্রশ্ন উঠে আসে, কর্তাদের পক্ষে তার উত্তর দেওয়া মুশকিল হবে। মানুষের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, সামাজিক ক্ষমতার সিঁড়ির নীচের প্রান্তে থাকা মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মান প্রদর্শন না করা ইত্যাদি নিয়ে এখন আর কেউ প্রশ্নও করেন না, কারণ তার চেয়ে অনেক ভয়ঙ্কর জিনিস পুলিশকর্মীরা হরহামেশা করে চলেছেন। কোনও পুলিশকর্মী বিক্ষোভ সামলানোর নামে আন্দোলনকারীর হাত কামড়ে আসেন। কিংবা চাকরিহারা শিক্ষকের বুকে বুট ঘষে দেন। সহকর্মীদের বিব্রত বয়ান আসে— মাথাগরম করে, ডাকাবুকো তো! কেউ আবার যৌন হেনস্থার পর নাবালিকা থানায় জানাতে এলে সারা রাত বসিয়ে রেখে নিপীড়নের নজির গড়েন। পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্দয়তা, হিংসা, অসংবেদী রূপ নিয়ে মানুষের ভূরি ভূরি অভিযোগ। ‘মন না-থাকা’র সব নিদর্শন যে সাধারণ মানুষের প্রতিই, তা-ও নয়। সার্ভিস রিভলভার বা রাইফেল চালিয়ে পুলিশকর্মীর আত্মহনন, সহকর্মীকে হত্যা ইত্যাদিকেও আর বিরলতম ঘটনা বলা চলে না। আবার, কর্মক্ষেত্রে হতাশ এক পুলিশকর্মী পাক সার্কাসের ভরা রাস্তায় কী ভাবে হঠাৎ জনতার দিকে ঠান্ডা চোখ রেখে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে, একটি প্রাণ কেড়ে নিজেকেও শেষ করেছিলেন, সেই আতঙ্ক তিন বছরেও কাটেনি।
সমাজের যে কোনও পেশাতেই যদি সামগ্রিক সংবেদনশীলতার অভাব ঘটে, তবে তা সুসংবাদ নয়— কিন্তু, পুলিশবাহিনীর ক্ষেত্রে ঘটনাটি চূড়ান্ত উদ্বেগজনক। আইনরক্ষা ও জনতাকে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। কেন পুলিশকর্মীদের মধ্যে এমন অসংবেদনশীল, রূঢ় হয়ে ওঠার প্রবণতা প্রকট, তার কারণ সম্ভবত বহুবিধ। একটি কারণ হল, পেশাদারি চাহিদা তাঁদের উপরে এক বিপুল চাপ তৈরি করে। কাজের পরিবেশ আরামপ্রদ নয়, কাজের সময়ও নির্দিষ্ট নয়। সমীক্ষায় প্রকাশ, পুলিশ বাহিনীর মধ্যে তিতিবিরক্ত স্বভাব, মনোযোগের অভাব, পরিবারকে সময় না দেওয়ায় দাম্পত্য সমস্যা খুবই প্রকট। কাজের প্রকৃতির জন্য ‘পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার’-এর মতো অসুখের সম্ভাবনাও তীব্র।
এই কর্ম-পরিস্থিতি পুলিশকর্মীদের মনের উপরে যে চাপ তৈরি করে, তার উপশম প্রয়োজন। ‘ওয়েলনেস সেন্টার’, ‘স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম’-এর কিছু ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু দৃশ্যত তা যথেষ্ট নয়। প্রত্যেকের জন্য কাউন্সেলিং, এবং প্রয়োজন অনুসারে মনঃচিকিৎসার ব্যবস্থা করা অবশ্য প্রয়োজন। পেশার বাইরে তাঁদের মানুষ হিসাবে সমাজজীবনে, পারিবারিক জীবনে অংশগ্রহণের অবকাশও থাকা প্রয়োজন। বিশেষ নজরে রাখতে হবে, কে কোন কারণে বিষণ্ণ, কারও আচরণে অসঙ্গতি ফুটে উঠছে কি না। মানসিক সমস্যা নিয়ে বাহিনীর মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা প্রসার করতে হবে, যাতে পেশাদার সাহায্য নিতে কেউ দ্বিধা না করেন। পাশাপাশি প্রয়োজন মানুষের সঙ্গে আচরণ বিষয়ক প্রশিক্ষণও। কোনও ব্যক্তির আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বা জাতি-ধর্ম-ভাষার মতো কোনও পরিচিতির বিচার না করেই তাঁকে সাহায্য করা, তাঁর প্রতি মানবিক আচরণ করা যে পুলিশের কর্তব্য, এই কথাটি কর্মীদের মাথায় গেঁথে দেওয়া প্রয়োজন। পুলিশবাহিনীর মন সুস্থ এবং সংবেদনশীল হওয়া সমাজের পক্ষে অপরিহার্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)