হয়তো কাকতালীয় নয়। এক দিকে যখন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জনগণনা এবং জাতগণনার ঘোষণা শোনা যাচ্ছে, সেই সময়েই তুঙ্গে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে ওবিসি তালিকাসংক্রান্ত বিতর্কও। ইতিমধ্যে অনগ্রসর শ্রেণি নিয়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের বিজ্ঞপ্তি পেশ করা হয়েছিল, কিন্তু হাই কোর্ট তাতে স্থগিতাদেশ দিয়েছে। ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, আদালত ২০১২ সালের আইন অনুযায়ী রাজ্যকে ওবিসি তালিকা তৈরি করতে বলেছিল, কিন্তু রাজ্য তা করেছে ১৯৯৩ সালের আইন মোতাবেক। উপরন্তু, আলোচনাভিত্তিক ভাবে কাজটি না করেই সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। আদালতের বক্তব্যে কঠোর সুর বেজেছে— রাজ্য সরকারের পদক্ষেপে আদালতের নির্দেশাবলির স্পষ্ট উপেক্ষার বিষয়ে। প্রসঙ্গত, কয়েক মাস আগেই রাজ্যের তরফে নতুন সমীক্ষার কথা বলা হয়েছিল, সেই সমীক্ষার রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে পাঠানোর কথা ছিল। কিন্তু সে কাজ হয়নি। হাই কোর্ট সঙ্গত ভাবেই এ বিষয়েও উষ্মা প্রকাশ করেছে। এক দিকে বিচারাধীন ওবিসি তালিকা নিয়ে রাজ্য সরকার ও উচ্চ আদালতের মধ্যে এতখানি উত্তাপ, অন্য দিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের দিক থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মুসলমান-তোষণের তীব্র অভিযোগ— সব মিলিয়ে ওবিসি কাঁটা এখন রাজ্য সরকারের পক্ষে রীতিমতো বেদনাদায়ক। ইতিমধ্যে এই রাজনৈতিক চাপান-উতোরে শামিল হল জাতীয় পশ্চাৎপদ জাতি কমিশনও (এনবিসিসি)— যারা গত কয়েক বছর ধরেই অভিযোগ করে আসছে যে রাজ্যের ওবিসি তালিকায় বহু (মুসলমান) গোষ্ঠীর নাম ঢোকানো হয়েছে অন্যায্য ভাবে।
সন্দেহ নেই, জাতবিষয়ক তথ্যে নানা অস্পষ্টতার অবকাশেই বিতর্ক এত তীব্র ও তিক্ত। ১৯৩১ সালের জাতগণনার তথ্য দিয়ে ২০২৫ সালের বিতর্ক মেটানো সহজ নয়। ইতিমধ্যে ২০১১ সালের জনগণনার সঙ্গে যে জাতগণনা হয়েছিল, তার তথ্য প্রকাশ্য করা হয়নি। মুসলমান সমাজের মধ্যে ওবিসি সংরক্ষণ চালু হওয়ার (২০১০) পর প্রথমে বামফ্রন্ট সরকার ওবিসি তালিকা সংশোধন করে। ২০১১ পরবর্তী সময়ে তৃণমূল সরকারের তত্ত্বাবধানে সেই তালিকা আরও দীর্ঘ হয়। এত সংখ্যক মুসলমান গোষ্ঠীকে কেন ও কী ভাবে তালিকাভুক্ত করা হল, এই প্রশ্নে রাজ্য সরকার জেরবার, সংখ্যালঘু তোষণের তীব্র অভিযোগে সঙ্কটাপন্ন। তবে কিনা, ভারতীয় গণতন্ত্রের দিক থেকে এ একটি আশ্চর্য মুহূর্ত বলতে হবে যখন জাতগণনা, বিশেষত তফসিলি জাতি-জনজাতির বাইরে যে অন্যান্য অনগ্রসর গোষ্ঠী— সেই ওবিসি-গণনা নিয়ে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার এবং রাজ্যে তৃণমূল সরকার একই সঙ্গে বিপদগ্রস্ত। বিজেপির দুশ্চিন্তা— জাতগণনায় ওবিসি ও অন্যান্য অতি অনগ্রসর গোষ্ঠীর সংখ্যা ও ব্যাপকতা শেষে হিন্দুত্ববাদের ভিতে কোনও ভাঙন ধরাবে কি না। আবার একই রাজ্যের আকারে বৃহৎ ও প্রকারে পশ্চাৎপদ ও দারিদ্রপীড়িত সংখ্যালঘু সমাজের কাছে মসিহা হিসাবে প্রতিভাত হতে ব্যগ্র তৃণমূল সরকার বিষম উদ্বিগ্ন, ওবিসি সংরক্ষণ তালিকার পরিবর্তনে মুসলমান সমর্থনে ভাটা পড়বে কি না তাই ভেবে।
তবে, এই মুহূর্তে সর্ববৃহৎ বিপদ ও উদ্বেগ— পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির। ওবিসি সংরক্ষণ কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত রাজ্য সরকারের সমস্ত নিয়োগ প্রক্রিয়াই স্থগিত ছিল, এখনও অনেকাংশে ব্যাহত হয়ে আছে। বিষম সঙ্কটাপন্ন স্কুল-কলেজের ভর্তি প্রক্রিয়া। সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ভর্তিতে আর কোনও বিলম্ব বা বাধা থাকবে না, এমনই শোনা গিয়েছিল নেতা-মন্ত্রীদের মুখে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা ঘটেনি। আপাতত বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় উপায়ান্তর না দেখে পুরনো ওবিসি তালিকা অনুযায়ী ভর্তি শুরু করছে। সামগ্রিক বিশৃঙ্খলার দায়িত্ব যে-হেতু রাজ্য সরকারেরই— ওবিসি তালিকা সংক্রান্ত সমস্ত ধোঁয়াশা পরিষ্কার করা এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)