E-Paper

কার প্রতিনিধি

ভারতের ক্ষেত্রে সেই অঙ্কটি ছিল এক কোটি পঁয়তাল্লিশ লক্ষ টাকা। কোনও ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি মানে তিনি ভারতের শীর্ষ এক শতাংশ ধনীর মধ্যে পড়েন।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৪ ০৭:৫০

—প্রতীকী ছবি।

লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থীদের সম্পত্তির বহর দেখে যদি কারও তাক লেগে যায়, তবে তিনি নির্ঘাত বিদায়ী সপ্তদশ লোকসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের টাকাপয়সার হিসাবের খোঁজ করেননি কখনও। ৫৪৩ জন সাংসদের মধ্যে ৪৭৫ জনেরই— অর্থাৎ সাড়ে সাতাশি শতাংশের— ঘোষিত সম্পদের পরিমাণ ছিল এক কোটি টাকার বেশি। সাংসদদের গড় সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় একুশ কোটি টাকা। এ বারের প্রার্থী-তালিকাতেও স্বভাবতই কোটিপতিদের ছড়াছড়ি। এই সম্পদের পরিমাণ ঠিক কতটা বেশি, তা বুঝতে গেলে তুলনা প্রয়োজন। নাইট ফ্র্যাঙ্ক নামক এক রিয়াল এস্টেট সংস্থা ২০২৩ সালে একটা হিসাব প্রকাশ করেছিল— কোনও দেশের শীর্ষ এক শতাংশ ধনী হতে গেলে অন্তত কত টাকার মালিক হওয়া প্রয়োজন। ভারতের ক্ষেত্রে সেই অঙ্কটি ছিল এক কোটি পঁয়তাল্লিশ লক্ষ টাকা। কোনও ব্যক্তির সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে বেশি মানে তিনি ভারতের শীর্ষ এক শতাংশ ধনীর মধ্যে পড়েন। অর্থাৎ, বিদায়ী লোকসভার সাংসদরা গড়ে দেশের ধনীতম এক শতাংশের নিম্নসীমার সাড়ে চোদ্দো গুণ বেশি বড়লোক। অতি ধনীদের হিসাব ছেড়ে যদি গড় আয়ের খবর নেওয়া যায়? ভারতে চাকরিজীবী শ্রেণির মধ্যে মাথাপিছু মাসিক আয় বত্রিশ হাজার টাকার কাছাকাছি। খেয়াল করা ভাল যে, দেশের মোট কর্মরত জনসংখ্যার দশ শতাংশেরও কম সংগঠিত ক্ষেত্রে নিয়োজিত, মূলত যাঁদের মাইনের হিসাব এখানে ধরা হয়েছে। অন্যদের বেতন আরও কম। কত কম? পশ্চিমবঙ্গেই গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনায় মজুরির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে দৈনিক ২৫০ টাকা— বছরে সর্বাধিক ১০০ দিনের কাজ, অর্থাৎ ২৫,০০০ টাকা। ২০২৩ সালেও ভারতে দারিদ্ররেখা ছিল শহরে মাসে ১৯০০ টাকার সামান্য বেশি, গ্রামাঞ্চলে ১৬০০ টাকার কিছু বেশি। এবং, সরকারি হিসাব মেনে নিলেও দেশের পাঁচ শতাংশের বেশি মানুষ এখনও এই দারিদ্রসীমার নীচে। এই দেশের সাংসদদের গড় সম্পদের পরিমাণ একুশ কোটি টাকা।

বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রথমত, যে সাংসদদের চল্লিশ শতাংশ নিজেদের পেশা হিসাবে পূর্ণ সময়ের রাজনীতি বা সমাজসেবার কথা উল্লেখ করেছেন, তাঁরা এমন বিপুল ‘ঘোষিত’ সম্পত্তির মালিক হন কী ভাবে? ক্ষেত্রবিশেষে ‘সমাজসেবা’ কি অতি অর্থকরী, যেমনটা মাঝেমধ্যেই অভিযোগ ওঠে? তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হল, যদি নির্বাচনে প্রার্থীদের একাংশ অতি ধনী হন, তা হলে গণতন্ত্রের ময়দান কি আদৌ সকলের জন্য সমান হয়? যাঁদের টাকার জোর আছে, তাঁরা নির্বাচনে সেই জোর খাটান। নির্বাচন ক্রমে বিপুল টাকার খেলা হয়ে দাঁড়িয়েছে— যাঁর সেই টাকা নেই, তাঁর নির্বাচনী ময়দানে প্রবেশাধিকারও নেই। কেউ চাইলেই নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে নাম নথিভুক্ত করতে পারেন— তা প্রত্যেক নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকার— কিন্তু, অধিকারটি নামমাত্রই। এর মোক্ষম উদাহরণ মেলে বিদায়ী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের মন্তব্যে। তিনি জানান, লোকসভা নির্বাচনে লড়ার মতো টাকার জোর তাঁর নেই। টাকার জোরকেই গণতন্ত্রের প্রবেশিকা করে তোলা গণতন্ত্রের আত্মাকে হত্যা করার শামিল।

তৃতীয় প্রশ্ন, যে দেশে সাধারণ মানুষের পান্তা ফুরোনোর জন্য নুন আনার সময়টুকুও লাগে না, সে দেশে কি এই অতি ধনীরা আদৌ জনপ্রতিনিধি হতে পারেন? কোন অর্থে তাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন? দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারের জীবন কেমন ভাবে কাটে, সে কথা নাহয় বাদই দেওয়া যাক— কোনও মধ্যবিত্তের জীবনের সঙ্কট, তার আশা-আশঙ্কা, উত্থানপতনের কোনও আঁচ কি এই প্রতিনিধিরা টের পান? তাঁদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব? এ কথা ঠিক যে, গণতন্ত্রে তাঁরাও সমান অধিকারী। কিন্তু, টাকার জোরই যদি প্রকৃতার্থে সেই অধিকার অর্জনের একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়, তবে তাকে আর গণতন্ত্র বলা যায় কি না, ভাবা প্রয়োজন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Politics Society India Economy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy