Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Jadavpur University

আবেদন

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামডাক সর্বজনবিদিত। পড়ুয়াদের সাফল্যের জন্যও বটে, আবার বিভিন্ন প্রতিবাদ আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে তার অগ্রণী ভূমিকার জন্যও বটে।

An image of Jadavpur University

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৩ অগস্ট ২০২৩ ০৪:৪৮
Share: Save:

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হস্টেলে ছাত্রমৃত্যুর মর্মন্তুদ ঘটনায় যে আলোড়ন দেখা দিয়েছে, তা অত্যন্ত সঙ্গত, জরুরি। তদন্তের দাবি, দোষীদের শাস্তির দাবি উঠে আসছে প্রবল ভাবে। কিন্তু একটি কথা এই সময়ে নাগরিক সমাজকেও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। শুধুমাত্র কয়েক জন দোষী আবাসিক ছাত্রকে কাঠগড়ায় তুললেই সঙ্কটের শেষ হবে, এমন ভাবা কিন্তু নিজেদের মিথ্যা প্রবোধ দেওয়া। এই সঙ্কট আসলে একটি পরিব্যাপ্ত সামাজিক রোগ, যার উৎস কোথায় আর তার প্রকোপ কতখানি, সেটি চিহ্নিত করা দরকার। না হলে আরও অনেক স্বপ্নদীপ এর শিকার হতে পারে। কেবল ছাত্রসমাজ নয়, পরবর্তী প্রজন্মের আরও বড় বড় ক্ষতি ঘটে যেতে পারে। অতিপরিচিত পারস্পরিক চাপান-উতোরের পথে আসল কাজটা যেন হারিয়ে না যায়।

স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রটিকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার তিন দিনের মধ্যে কেন প্রাণ হারাতে হল, সেটা ক্রমে পরিষ্কার হচ্ছে। যতগুলি বয়ান সংবাদমাধ্যমের গোচর হয়েছে, তাতে যৌন উৎপীড়নের বিষয়টি নিয়ে সংশয় নেই। কোন ধরনের র‌্যাগিংয়ের রেওয়াজ যাদবপুর ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান, সেটা সমাজমাধ্যমে বিভিন্ন পড়ুয়ার বয়ান থেকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, এই বাস্তবতা কি কর্তৃপক্ষ জানেন না? যদি না জানেন, সেটা তাঁদের অপরিসীম উদাসীনতা, যেটাকে অপরাধ বলে গণ্য করা যায়। ঘটনার রাতে কর্তৃপক্ষকে ফোন করার পরেও কেউ যে সে ভাবে নড়ে বসেননি, সে কথা শুনে সিদ্ধান্ত করতেই হয়, তাঁদের অপরাধ দোষী ছাত্রদের চেয়ে কম নয়। আর বাস্তব পরিস্থিতি জানা সত্ত্বেও তাঁরা বছরের পর বছর এই ট্র্যাডিশন চলতে দিয়েছেন— এও এক অমার্জনীয় অপরাধ। এর একটি কারণ কি এই নয় যে, ছাত্র ও কর্তৃপক্ষ, সকলের মধ্যেই এখনও পর্যন্ত স্বাধীনতার ধারণাটিই বড় গোলমেলে। স্বাধীনতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতা আর উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের নামে নীতি-পুলিশি, এই দুই চরমপন্থার বাইরে কোনও পরিসর তৈরি হয় না। স্বাধীনতা বলতে যে অন্যকে স্বাধীনতা দেওয়া, এটা এখনও নাগরিক জীবনে ভাবনার পরিধিতে নেই। তারই খেসারত হিসাবে স্বপ্নদীপরা হারিয়ে যায় চিরতরে। স্বপ্নদীপ বার বার বলে চলেছিল, সে সমকামী নয়। কোন প্ররোচনা থেকে তাকে এ কথা বার বার বলতে হল, সেটুকু অনুমান করা দুঃসাধ্য নয়। এখানেই নিপীড়নের প্রশ্নটি অতিক্রম করে একটি বৃহত্তর স্বাধীনতার প্রশ্ন উঠে আসে। এবং এই স্বাধীনতার মধ্যে যৌন স্বাধীনতা ও মর্যাদাও পড়ে বইকি। দেশের অন্যতম অগ্রণী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি আজও তার পড়ুয়াদের একটা বড় অংশের মধ্যে সেই সচেতনতার প্রসার না ঘটাতে পেরে থাকে, তা হলে প্রতিষ্ঠান সেই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করুক। অভিভাবক সমাজ যদি সন্তানদের অন্যকে স্বাধীন মর্যাদা দেওয়ার শিক্ষা দিতে না পেরে থাকেন, তা হলে তাঁরা এই অবকাশে নিজেদের ‘খুনি’ বলে স্বীকার করুন। প্রত্যক্ষ অপরাধীরা শাস্তি পাওয়ার দাবির পাশে এগুলিও অত্যন্ত জরুরি দাবি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামডাক সর্বজনবিদিত। পড়ুয়াদের সাফল্যের জন্যও বটে, আবার বিভিন্ন প্রতিবাদ আন্দোলনে, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে তার অগ্রণী ভূমিকার জন্যও বটে। এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ছাত্র আবাসে বছরের পর বছর ধরে দাদাগিরি আর দিদিগিরির ঘুঘুর বাসা লালিত হয়ে আসছে? বাইরে থেকে ছেলেমেয়েরা এখানে অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়তে আসে। ছাত্র আবাসগুলি যদি এই ভাবে সামাজিক ডারউইনীয় তত্ত্ব প্রয়োগের পরীক্ষাগার হয়ে ওঠে, এবং তার সঙ্গে দলবাজি, ইউনিয়নবাজি, বিভাগীয় আধিপত্য, এলাকাভিত্তিক ‘বেরাদরি’ মিলেমিশে হরেক চোরাস্রোত তৈরি করে, তা হলে তা প্রতিহত করার দায়িত্ব কার? যে পড়ুয়া মিছিলের প্রথম সারিতে সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে গলা ফাটাচ্ছে, সে-ই হস্টেলে ফিরে নিজস্ব ‘খাপ পঞ্চায়েত’ বসাচ্ছে এবং মিছিলের মুখ হয়ে ওঠার সুবাদে বেশি করে কলার তুলছে। প্রত্যন্ত এলাকা থেকে পড়তে আসা, ইংরেজিতে কাঁচা যে ছাত্র শ্রেণিকক্ষে অপরীকরণের মুখে পড়ছে, হস্টেলের নিজস্ব রাজ্যপাটে তারই দাপট হয়তো গগনচুম্বী। যে প্রতিষ্ঠান নিজের প্রগতিশীলতার গৌরবে মটোমটো, তারই উপরতলার প্রশাসনের নীচে ঘন কালো নৈরাজ্যপাতাল। যে অভিভাবকরা ভাবেন তাঁরা সন্তান ‘মানুষ’ করছেন, তাঁরা অনেকে নিজেরাই মনুষ্যত্বের সংজ্ঞাটি ঠিক জানেন না। প্রত্যেককে এই প্রবঞ্চনা পেরিয়ে আত্মচেতনায় পৌঁছনোর আবেদন জানিয়ে গেল কিশোর স্বপ্নদীপ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE