দীর্ঘ আঠারো মাস অতিক্রান্ত। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছেই। জেরবার বিশ্বপৃথিবী। বহুকাঙ্ক্ষিত শান্তির খোঁজে সম্প্রতি এক শান্তি অধিবেশনে সৌদি আরবের জেড্ডা শহরে মিলিত হলেন চল্লিশটিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা। কূটনৈতিক উদ্যোগটি ছিল মূলত ইউক্রেনের তরফে। যদিও রাশিয়াকে এই অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। প্রসঙ্গত, গত বছর খেরসন এবং খারকিভ থেকে সেনা প্রত্যাহারের পরে রাশিয়া আবার ইউক্রেনে এগোতে শুরু করেছে। যদিও যুদ্ধের যে প্রভাব পড়ছে তাদেরই রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি সুরক্ষা ক্ষেত্রেও, তা নিয়ে মস্কোর দুশ্চিন্তা বাইরে থেকেও অনুমান করা যায়। অন্য দিকে, পশ্চিমের সামরিক সাহায্যে ইউক্রেন-ও যে ভাবে পালাবদলের আশা করেছিল, তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি সে দিকেও। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির শান্তি পরিকল্পনা অনুযায়ী, দ্বিপাক্ষিক কথোপকথন চালু করতে হলে তাঁর দেশের সব অধিকৃত অঞ্চল থেকে রাশিয়াকে সেনা সরাতে হবে। আর মস্কোর দাবি, ইউক্রেনের যে অঞ্চলগুলি রুশ সেনা দখল করেছে, সেগুলি তো বটেই, যে অঞ্চলগুলির উপরে বর্তমানে তাদের সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেই, সেগুলিকেও রাশিয়ার অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে জেড্ডা অধিবেশনে রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদে উল্লিখিত যে কোনও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার আন্তর্জাতিক আইনকে মান্যতা দেওয়ার পক্ষেই সওয়াল করলেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা। ফলে রাশিয়াকে একঘরে করার পাশাপাশি স্থায়ী শান্তি স্থাপনে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলিকেও দলে টানার যে উদ্দেশ্য নিয়ে ইউক্রেন অধিবেশনটির আয়োজন করেছিল, তাতে সে যে অনেকাংশেই সফল, এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট।
তবে সাম্প্রতিক অধিবেশনটি আরও নজর কাড়ে চিনের নতুন অবস্থানের কারণে। গত জুনেই কোপেনহেগেন-এ অনুষ্ঠিত এক অনুরূপ অধিবেশনে যোগ দেয়নি সে। তার আগে, গত মার্চে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য একটি খসড়া পেশ করে চিন। যদিও সেটির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল কোনও রাষ্ট্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা বজায় রাখার আন্তর্জাতিক আইনের সূত্র ধরে তাদের তাইওয়ান-কে কুক্ষিগত করার অভিসন্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। একই সঙ্গে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিষয়েও সওয়াল করে সে। ফলে খসড়াটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু শান্তি প্রক্রিয়া স্থাপনে যে ভাবে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য জোরদার করতে জেড্ডা অধিবেশনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে চিন মন্ত্রকের বিবৃতিতে, তাতে ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, রাশিয়া-ইউক্রেনের কোনও ধরনের সমঝোতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রটি। অন্য দিকে, বিশ্বব্যাপী অস্থিরতার মাঝে এখনও পর্যন্ত মধ্যপন্থার ভূমিকাটি ভারতও যে দক্ষতার সঙ্গে পালন করে এসেছে, এমন দাবি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। একাধিক পরিস্থিতিতে মস্কোকে কূটনীতি এবং আলোচনার পথ অবলম্বনের কথাই বলে এসেছে ভারত। জেড্ডা অধিবেশনে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের বক্তব্যেও সেই মনোভাবই পুনরায় ধ্বনিত হয়। মনে রাখতে হবে, বর্তমানে জি২০-র প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থাকার সুবাদে, এই শান্তি প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার সুযোগ রয়েছে ভারতের। অবশ্য এই শান্তি উদ্যোগকে আদৌ সফল বলা যাবে কি না, সময়ই তা বলবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)