Advertisement
১৫ জুন ২০২৪
Uttarkashi Tunnel Rescue Operation

চিন্তা তবু মিটল না

কিন্তু দুশ্চিন্তার যেখানে শেষ, সেখানেই সুচিন্তা শুরু করা জরুরি। প্রথমত, দুর্ঘটনার পর থেকে পক্ষকালের বেশি সময় ব্যাপী উদ্ধারের প্রক্রিয়াটি নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন থেকে গিয়েছে।

uttarkashi tunnel collapse

উত্তরকাশীর ভাঙা সুড়ঙ্গে চলছে উদ্ধারকাজ। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৭
Share: Save:

মঙ্গলবার রাত্রি ন’টার একটু আগে দেশ জুড়ে, এবং বাইরের পৃথিবীতেও, অগণন হৃদয় থেকে একটি প্রগাঢ় নিঃশ্বাস নিষ্ক্রান্ত হয়েছিল। স্বস্তির নিঃশ্বাস। সুদীর্ঘ চারশো ঘণ্টা ধরে জমে ওঠা উদ্বেগ এবং দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত হওয়ার স্বস্তি। কোনও সন্দেহ নেই, ষোলো দিন যাবৎ উত্তরকাশীর সিল্কিয়ারায় ভেঙে-পড়া সুড়ঙ্গে বন্দি হয়ে পড়া ৪১ জন শ্রমিকের জন্য কেবল তাঁদের পরিবার পরিজন বা পরিচিত মানুষেরা নয়, আরও অসংখ্য নাগরিক এই প্রার্থনায় সমবেত ছিলেন যে, ওঁরা যেন অক্ষত এবং সুস্থ অবস্থায় ওই অন্ধকূপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। সেই প্রার্থনা চরিতার্থ হয়েছে। তার পাশাপাশি, উদ্ধারের কাজে জীবন পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়া খননকর্মীরাও সকলে সুস্থ, সফল, বিজয়ী হয়েছেন। উজ্জ্বল উদ্ধারের সেই মুহূর্তে ‘স্বস্তি’ শব্দটি বাস্তবিকই তার আক্ষরিক অর্থে ভাস্বর হয়ে উঠেছিল: ‘সু অস্তি’— ভাল আছে, সবাই ভাল আছে।

কিন্তু দুশ্চিন্তার যেখানে শেষ, সেখানেই সুচিন্তা শুরু করা জরুরি। প্রথমত, দুর্ঘটনার পর থেকে পক্ষকালের বেশি সময় ব্যাপী উদ্ধারের প্রক্রিয়াটি নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন থেকে গিয়েছে। আকস্মিক বিপর্যয়ের অভিঘাত সামলে মোকাবিলায় নামতে প্রাথমিক বিভ্রান্তি বা বিচ্যুতি অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু কার্যত গোটা পর্বের শেষ অবধি সংশ্লিষ্ট প্রশাসকদের একাংশের কথায় ও আচরণে এক ধরনের অস্থিরতা ও দোলাচলের পরিচয় পাওয়া গিয়েছে, যা আস্থা জাগায় না। শেষ অবধি যে ‘র‌্যাট মাইনার’দের মানুষী অভিজ্ঞতা ও সঙ্কল্পের ভূমিকা এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, তা যেমন তাঁদের প্রতি সমস্ত দেশবাসীর অপার কৃতজ্ঞতার কারণ, তেমনই বিপর্যয় মোকাবিলার ষোড়শোপচার সজ্জিত আয়োজনের অসম্পূর্ণতার পরিচায়ক হয়ে থাকল। এ কথাও বিশেষ ভাবে মনে রাখা দরকার যে, ওই সাহসী শ্রমিকরা তাঁদের দক্ষতা অর্জন করেন ‘অবৈধ’ খনিতে কাজ করার সূত্রে। যে ব্যবস্থাকে অ-স্বাভাবিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় অ-স্বাভাবিক দক্ষতার উপর নির্ভর করতে হয়, তার হাল-হকিকত নিয়ে ব্যাপক ও গভীর অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা জরুরি। দ্বিতীয়ত, পর্যালোচনা আবশ্যক দুর্ঘটনার কারণ নিয়েও। সংশ্লিষ্ট সুড়ঙ্গের নির্মাণে যথেষ্ট রক্ষাকবচ রাখা হয়েছে কি না, দ্রুত কাজ শেষ করার তাড়নায় নিরাপত্তার প্রশ্নে আপস করা হয়েছে কি না, এই বিষয়ে বড় রকমের প্রশ্ন শোনা গিয়েছে। তার কতখানি ন্যায্য, সে বিষয়ে তদন্ত জরুরি। কিন্তু এমন প্রশ্ন যে উঠেছে, সেটাই গভীর উদ্বেগের কারণ। শ্রমিকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে ঔদাসীন্য এ দেশে সর্বব্যাপী, এ ক্ষেত্রেও কি সেই ঐতিহ্যই বহাল ছিল? ‘সব ভাল যার শেষ ভাল’ গোছের ফাঁকা কথা এবং দেবদেবী ও নায়কনায়িকাদের প্রতি অন্ধভক্তির বাইরে দাঁড়িয়ে এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা আবশ্যক।

উত্তর খোঁজা দরকার আরও অনেক বেশি মৌলিক প্রশ্নের: এই সুড়ঙ্গ নির্মাণের প্রয়োজনটি কি জরুরি ছিল? উত্তরকাশীর মতো অঞ্চলে, বস্তুত, ‘নবীন’ হিমালয়ের বিস্তীর্ণ এলাকাতে যে-কোনও বড় রকমের নির্মাণই যে ভূপ্রকৃতির পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে, সে-কথা এখন সর্বজনবিদিত। সুস্থায়ী উন্নয়ন বা প্রকৃত জনকল্যাণের স্বার্থে অথবা জাতীয় নিরাপত্তার একান্ত প্রয়োজনে নিশ্চয়ই ক্ষেত্রবিশেষে এমন নির্মাণের প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু সেই অজুহাতে নিছক বাণিজ্যিক কারণে বা ধর্মীয় আবেগের সুযোগ নিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের তাগিদে পাহাড়ের বুকে অপ্রয়োজনীয় আঘাত করে চলার ধারাটি সম্পূর্ণ বন্ধ করা দরকার নয় কি? ধর্মপ্রাণ মানুষ নিশ্চয়ই তীর্থযাত্রা করবেন, সেই যাত্রাপথকে যতটা সম্ভব সহজ করা হবে, তা নিয়ে আপত্তি থাকতে পারে না। কিন্তু সে পথকে কতটা সহজ করা সম্ভব, তার বিচার প্রকৃতি এবং পরিবেশকে বাদ দিয়ে হতেই পারে না। এই বিপর্যয়ের পরে সততার সঙ্গে এই প্রশ্নগুলির মুখোমুখি দাঁড়ানো দরকার। তা না হলে মঙ্গলবারের স্বস্তি নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী হতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE