Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
Politics

শিক্ষানুরাগী?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে তার ভূমিকাটি পরামর্শদাতার, প্রয়োজনে নজরদারেরও— কিন্তু নিয়ন্ত্রকের নয়।

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২২ ০৫:৩২
Share: Save:

শিক্ষায় দলতন্ত্রের অভিযোগটি নতুন নয়। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট আমলে ‘অনিলায়ন’ দেখিয়েছিল, শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে দলীয় সদস্য বসানোর প্রক্রিয়াটি কতখানি সুচারু ভাবে সম্পন্ন করা যায়। আশ্চর্য নয় যে, ‘পরিবর্তনের সরকার’ও সেই পথেই পা বাড়িয়েছে। তদুপরি, আরও এক ধাপ এগিয়ে কলেজের পরিচালন সমিতিতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর প্রতিনিধিত্ব কমিয়ে সরকারের মনোনীত লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই ‘শিক্ষানুরাগী’দের অনেকের সঙ্গেই দীর্ঘ দিন মা সরস্বতীর ফৌজদারি মকদ্দমা চলছে! তাঁদের মধ্যে কেউ অষ্টম শ্রেণির চৌকাঠ না ডিঙিয়েও কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতির পদটি অলঙ্কৃত করেছেন, কেউ একই সঙ্গে ১৩টি কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি। একই ভাবে ছাত্র না হয়েও ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবে পরিচালন সমিতির বৈঠকে উপস্থিত থাকার উদাহরণও দেখা গিয়েছে। তালিকা সুবিস্তৃত। এই নিয়ে ইতিপূর্বে প্রতিবাদ, বিক্ষোভও অবস্থার কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। এত কাল পরে যে সেই মণিমুক্তোগুলি উঠে আসছে, তার কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বিপুল দুর্নীতির পর্দা ফাঁস। দেখা গিয়েছে, শুধুমাত্র শাসক দলের, বা আরও নির্দিষ্ট ভাবে শিক্ষামন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ হওয়ায় তাঁদের এ-হেন বাড়বাড়ন্ত।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালন সমিতির মাথায় স্থানীয় প্রতিনিধি বা জনপ্রতিনিধিদের রাখার অন্তত ঘোষিত উদ্দেশ্যটি ছিল যে, তাঁরা জনসাধারণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবেন। এই কারণেই মেডিক্যাল কলেজে রোগী কল্যাণ সমিতি তৈরি হয়েছিল, স্কুল-কলেজের পরিচালন কমিটিতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা হয়েছিল। রাজনীতির ধর্ম মেনে পদগুলি রাজনৈতিক নেতা বা তাঁদের ঘনিষ্ঠদের কুক্ষিগত হয়েছে। সেই স্রোতে ভেসে এসেছে দুর্নীতিও। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে অর্থের বিনিময়ে আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগ, এমনকি তহবিল নয়ছয়ের অভিযোগও উঠেছে এঁদের নামে। আঞ্চলিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ, ছাত্রকল্যাণের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধিকে ছাপিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলি মূলত দলাদলি এবং ক্ষমতা দখলের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এবং স্বচ্ছতা, নিয়মানুবর্তিতা, সর্বোপরি স্বকীয়তাও হারিয়ে ক্রমে প্রতিষ্ঠানগুলি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। মেডিক্যাল কলেজের মতো অনেক ক্ষেত্রে ছাত্ররাই এ-হেন অহেতুক হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে পথে নেমেছে।

এই ব্যবস্থাটি অবিলম্বে তুলে দেওয়াই বিধেয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষাদান। তা কখনও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে না। তাই যে রন্ধ্রপথ দিয়ে রাজনীতি শিক্ষাঙ্গনে প্রবেশ করে, সেই পথটি বন্ধ করতে হবে। অন্য দিকে, ছাত্র ভর্তি থেকে শুরু করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করতে পারে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে তার ভূমিকাটি পরামর্শদাতার, প্রয়োজনে নজরদারেরও— কিন্তু নিয়ন্ত্রকের নয়। যে মুহূর্তে শিক্ষা শাসকের প্রভাবাধীন হয়ে পড়ে, সেই মুহূর্তে তার মৌলিক উদ্দেশ্যটিই নষ্ট হয়ে যায়। তখন পড়ে থাকে শুধুই রাজনীতির কুনাট্য। সেই বিপদ থেকে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল-কলেজগুলিকে বাঁচানো প্রয়োজন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Politics Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE