—প্রতীকী চিত্র।
বাজার থেকে রসুই, আর তা থেকে রসনা— এই পথটুকুতে ট্র্যাফিক পুলিশের অভাব নেই। ভক্ষ্য-অভক্ষ্য নিয়ে তিথি-নক্ষত্রের ভ্রুকুটি প্রায় সব ধর্ম-সংস্কৃতিতেই রয়েছে। ইদানীং পঞ্জিকাকে ছাপিয়ে গিয়েছে প্রেসক্রিপশন। ওষুধের তালিকার সঙ্গেই নিষিদ্ধ খাবারের ফর্দ লিখে দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা। যে কোনও চটজলদি খাবারের মোড়কে ছাপার অক্ষরে লেখা থাকছে ক্যালরির পরিমাণ, উপকরণের বিবরণ। প্রলুব্ধ রসনার সামনে অগণিত লাল বাতি। সেখানে স্বাস্থ্যরক্ষার মতোই গুরুত্ব পাচ্ছে পরিবেশের সুরক্ষা। এক কাপ চা মানে কেবল এক কাপ জল তো নয়। এক কিলোগ্রাম চিনি তৈরি করতে ১৭৮০ লিটার জল লাগে, আর এক কাপ চা তৈরির মতো চা পাতা তৈরি করতে লাগে ত্রিশ লিটার জল। বিদেশি ফল-আনাজ দেখতে মনোহর, খেতেও উপাদেয়, কিন্তু বিমানযাত্রায় যে অতিকায় কার্বন-পদচিহ্ন রেখে তারা এল, তাকে হিসাবে ধরলে বারুইপুরের পেয়ারা, বা বাঁকুড়ার কুমড়োর দিকে মন ঝুঁকতে পারে। অর্থাৎ, খাবার নির্বাচনে কেবল বাসনা নয়, বিবেক আর বুদ্ধিও কাজে লাগাতে হবে। কী খাব, কী খাব না, তার নির্বাচন আরও যুক্তিপূর্ণ, কল্যাণময় করার উদ্দেশ্যে নিত্য নতুন পরিমাপ তৈরি হচ্ছে। তেমনই একটি নতুন সূচক সম্প্রতি প্রকাশিত হল, তা জীববৈচিত্রের। বিশ্বের ১৫১টি জনপ্রিয় খাবারের কোনটি জীববৈচিত্রের উপরে কতখানি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, সম্প্রতি তার একটি পরিমাপ তৈরি করেছেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর-এর বিজ্ঞানীরা। স্পেনের মাটন কারি হোক, আর দক্ষিণ ভারতের ইডলি, প্রিয় পদটির উপকরণগুলি চাষ করার সময়ে সেই সব জমির প্রাকৃতিক প্রাণিসম্পদ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পাখি-পোকা থেকে বন্য পশুরা একেবারে উৎখাত বা নিশ্চিহ্ন হয়েছে কি না, তা খোঁজ করে দেখা হয়েছে। বিজ্ঞানীদের দাবি, এর থেকে হয়তো একটা ধারণা করা যায় যে মানুষের দৈনন্দিন, গার্হস্থ জীবনের চাহিদাগুলি কত প্রজাতিকে দ্রুত নিশ্চিহ্ন হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এই পরিমাপের ফলাফল খানিকটা বিস্মিত করেছে বিজ্ঞানীদেরও। কার্বন নিঃসরণ কমানো, বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা বাড়াতে বাণিজ্যিক প্রাণী-পালনে নিয়ন্ত্রণ দরকার, এ কথা জানাই ছিল। জীববৈচিত্রের সূচকে দেখা গেল, ইডলি কিংবা রাজমার মতো নিরামিষ পদও এ ব্যাপারে কম যায় না। জীববৈচিত্রের উপর কুপ্রভাবের নিরিখে এ দু’টি পদের স্থান ষষ্ঠ এবং সপ্তম, মাংসের পদগুলির খুব কাছাকাছি। তার কারণ বোঝা অবশ্য কঠিন নয়— ধান আর ডাল, এ দু’টির চাষের জন্যেই স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্রের প্রচুর পরিবর্তন করা হয়— বন কেটে খেত তৈরি করা কেবল তার শুরু। তার পর রয়েছে নানা রাসায়নিকের প্রভাব, যা পোকা, পাখির স্বাভাবিক বিচরণভূমিকে নষ্ট করে। প্রবীণদের অনেকেরই মনে এখনও ধানখেতের জলে মাছ ধরার স্মৃতি জাগরূক। কিন্তু সে মাছেরা এখন অদৃশ্য, সার আর কীটনাশকের তীব্রতায়। খেতের রাসায়নিক পুকুর, নদীতে মেশার ফলে বহু প্রজাতির দেশি মাছও নিশ্চিহ্ন, মৎস্যজীবীদের মুখে তাদের নাম শোনা যায়। এক কথায়, বাণিজ্যিক হারে ফসল উৎপাদন
ব্যবস্থা যেমন বহু মানুষকে সুলভ খাদ্য জোগাচ্ছে, তেমনই পাশাপাশি চলছে এক নীরব নিধনযজ্ঞও। একের গ্রাস কত প্রজাতির সর্বনাশ ঘটাচ্ছে, তার একটা আন্দাজ দিল
জীববৈচিত্রের সূচক।
কিন্তু তাতে হল কী? কাপের কফিতে দাসশ্রম, পাতের ভাতে ভূগর্ভ-নিঃশেষিত জল, বাটির ঝোলে ম্যানগ্রোভ-ঘাতী ভেড়ির মাছ— এমন সব তথ্য কি আমাদের শক্তি জোগায়, না কি আরও বেশি করে অসহায় করে? মানবজীবনের বহু বিষাদ, অচরিতার্থতা, অজস্র অনপনেয় সঙ্কট সহনীয় হয় একটু সুস্বাদু, সুগন্ধী সুখাদ্যের স্পর্শে। পেট কিংবা পকেট যাঁদের বৈরী, তাঁরাও মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করেন ভাবনাটা, আজ কী খেলে ভাল হত? গরম ভাতের গন্ধের মতোই এই চিন্তা শরীর-মনকে জাগ্রত করে। খাবারের পাতে বিরাট, জটিল সঙ্কটগুলিকে ডেকে আনা কেন? কারণ বিবেকের ধর্মই তাই— নিতান্ত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেও গ্রহণীয়-বর্জনীয়, উচিত-অনুচিতের বিচার করে যাওয়া। আসলে শেষ পর্যন্ত একক আহার বলে কিছু হয় না, প্রতিটি প্রাণীই একে অপরকে আহার জুগিয়ে চলেছে জীবনে-মরণে। সেই বৃহতের বোধ, বিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্রের চেতনাকে যখনই ঠেলে দেওয়া হয় পাতের বাইরে, তখনই আত্মবিস্মৃত হয় মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy