E-Paper

খোলা চোখে

এত দিন যে মূর্তিরূপ চলে এসেছে, তাকে পাল্টানোর এই উদ্যোগে কি তবে ঐতিহ্যের অমর্যাদা করা হল? তেমন কথা বললে ঐতিহ্য বা ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হবে না।

শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৫৬
পুরনো (বাঁ দিকে) এবং নতুন (ডান দিকে) ভারতীয় ন্যায়ের প্রতীক। ছবি: পিটিআই।

পুরনো (বাঁ দিকে) এবং নতুন (ডান দিকে) ভারতীয় ন্যায়ের প্রতীক। ছবি: পিটিআই।

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের গ্রন্থাগারে বিরাজমান হয়েছেন ন্যায়বিচারের নতুন প্রতিমা। তাঁর এক হাতে তুলাদণ্ড, অন্য হাতে সংবিধান, এবং এত দিনের সুপরিচিত ন্যায়ের দেবীর মতো এই মূর্তির দু’চোখ আবৃত নয়, উন্মুক্ত। এই নবপ্রতিমা বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বিশেষত তাঁর মুক্তচক্ষু দেখে অনেকেই বিস্ফারিত নয়নে প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এই পরিবর্তন? এত দিন জানা ছিল, ন্যায়ের দেবীর চোখ বাঁধা থাকে, কারণ তিনি (বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কোনও পক্ষের) কাউকে ‘চেনেন’ না, ফলে কারও প্রতি তাঁর কোনও ধরনের পক্ষপাত থাকতে পারে না। এই না-চেনার অর্থ হল, আদালতের বিচার সম্পূর্ণ নিষ্পক্ষ। ন্যায়প্রতিমার মূর্তিটি সেই নিষ্পক্ষতার প্রতীক। তা হলে আজ কি সেই পক্ষপাতশূন্যতার ঐতিহ্য বর্জন করা হল? না। প্রধান বিচারপতি জানিয়েছেন, আদালত এবং তার বিচারের নিরপেক্ষতার ধারণাটিকে নতুন করে মর্যাদা দেওয়ার জন্যই এই নতুন মূর্তিকল্পনা। তাঁর ভাষায়, “আইন দৃষ্টিশক্তিহীন নয়, তা সবাইকে সমান ভাবে দেখে।” অর্থাৎ, ন্যায্যতার এই প্রতিমূর্তির দুই খোলা চোখের দৃষ্টিতেই আছে পক্ষপাতশূন্য বিচারের আশ্বাস।

এত দিন যে মূর্তিরূপ চলে এসেছে, তাকে পাল্টানোর এই উদ্যোগে কি তবে ঐতিহ্যের অমর্যাদা করা হল? তেমন কথা বললে ঐতিহ্য বা ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করা হবে না। জাস্টিস বা ন্যায়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবীর কল্পনাটি যে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সংস্কৃতির ধারা থেকে সমাগত, সেখানে প্রতিমার চোখ বাঁধা ছিল না। অর্থাৎ আদিকল্পে তিনি খোলা চোখেই ন্যায়বিচার দিতেন। তাঁর চোখ বাঁধার রীতি শুরু হয় পঞ্চদশ শতকের শেষে বা ষোড়শ শতকের গোড়ায়। এবং বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসাবে নয়, বিচারের নামে অবিচারের বাস্তবের প্রতি সুতীব্র পরিহাস ছুড়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই দেবীর চোখ দু’টি আবৃত করা হয়েছিল। ওই আবরণী ছিল নেতিবাচক। এই রূপকল্পনার ইতিবাচক ব্যাখ্যাটি প্রচলিত হয় অনেক পরে। ক্রমে সেই ব্যাখ্যাই জনমনে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত ব্রিটেনে। অতঃপর, ঔপনিবেশিক ইতিহাসের অঙ্গ হিসাবেই, ভারতীয় শাসনতন্ত্রের পরিমণ্ডলে ন্যায়ের দেবী ওই প্রচলিত রূপটি ধারণ করে আবির্ভূত হন। তবে এ দেশেও এই রূপটির একচ্ছত্র অধিকার তৈরি হয়নি— বিভিন্ন পরিসরে, এমনকি সর্বোচ্চ আদালতেও মুক্তনয়না ন্যায়প্রতিমা বিরল নয়। কিন্তু সুবিচারের দেবীর চোখ ঢাকা দেওয়ার মধ্যে প্রচলিত বা স্বাভাবিককে অতিক্রম করার অবকাশ আছে, ছক-ভাঙা বৈচিত্র আছে, সেই ব্যতিক্রমী বৈচিত্রের গূঢ় অর্থ নিয়ে ভাবনাচিন্তা, আলোচনা ও জল্পনার সুযোগ আছে। তাই জনমানসে চোখ-বাঁধা দেবীপ্রতিমার আকর্ষণ স্বভাবতই বেশি।

শুধু এইটুকুই? কেবলমাত্র বৈচিত্রের আকর্ষণ? মূর্তিকল্পনাটির মধ্যে ন্যায় বা ন্যায্যতার কোনও গভীর ধারণা কি নিহিত নেই? অবশ্যই আছে। এবং সেই কারণেই একটি গূঢ় প্রশ্ন উঠে আসে। ন্যায্যতার দেবী যদি চোখ খোলা রাখেন এবং সেই খোলা চোখে সব কিছু দেখেন, তা হলেই কি নিশ্চিত ও নিশ্চিন্ত হওয়া যায় যে তিনি সব কিছুকে সমদৃষ্টিতে দেখবেন? দেখতে পারবেন? দেখতে চাইবেন? তিনি এবং তাঁর বিচারালয় কি সত্যই নিজেকে সমাজের ঊর্ধ্বে রাখতে সক্ষম? যদি তা না হয়? সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তব যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদাধিকারীদের পক্ষপাতদুষ্ট মানসিকতা ও আচরণের অজস্র প্রমাণ দিয়ে চলে, তখন এ-প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে। শাসক তথা ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালীরা অপ্রিয় অনভিপ্রেত অস্বস্তিকর সত্যকে গোপন করার এবং সুবিধাজনক তথ্য ও যুক্তি সাজিয়ে সুবিচারের পথে লক্ষ বাধা সৃষ্টির যে অক্লান্ত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন, তা যদি ন্যায়ের প্রতিমাকে বিভ্রান্ত করে? তাঁর খোলা চোখ দু’টিই যদি সেই বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়? তার থেকে কি বাইরের চোখ দু’টি আবৃত রাখাই শ্রেয় নয়? অর্ধসত্য, বিকৃত-সত্য এবং উত্তর-সত্যের এই সর্বগ্রাসী অভিযানের মুখে দেবী যদি আপন অন্তর্দৃষ্টিতেই মনঃসংযোগ করেন, হয়তো তাঁর সত্যদর্শনের পথটি তুলনায় নিষ্কণ্টক ও বাধাহীন থাকতে পারবে। অন্য যাবতীয় দেবদেবীর মতোই তিনিও তো মানুষেরই সৃষ্টি, সুতরাং মানুষী দুর্বলতা থেকে তাঁর হৃদয় ও মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ মুক্ত রাখতে পারবেন, এমন প্রত্যাশা করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হয় না কি? চোখ খুলে দিয়ে তাঁর চিরসুকঠিন কাজটিকে আরও কঠিন করে দেওয়া হল কি না, মাননীয় বিচারপতিরা সে-কথা ভেবে দেখতে পারেন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Supreme Court of India

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy