E-Paper

দুই অস্ত্র

বিহারের বিভিন্ন জনসভায় রাহুল-তেজস্বীকে এক সঙ্গে দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু জোটধর্মের খামতিও স্পষ্ট হয়ে উঠছে মাঝেমধ্যেই।

শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:২৪

মাথাপিছু আয়ের নিরিখে ভারতের অন্যতম পশ্চাৎপদ রাজ্য; পরিযায়ী শ্রমিকের জোগানের নিরিখে অগ্রগণ্য। এ-হেন একটি রাজ্যের নির্বাচনে প্রধানতম প্রশ্ন হতে পারত কর্মসংস্থান, আর্থিক উন্নতি। বিহারের দুর্ভাগ্য, এই নির্বাচনটিও আটকে রইল সেই পুরনো জাতপাতের সমীকরণে; তার সঙ্গে যোগ হল নগদ পাইয়ে দেওয়ার আধুনিক বিশল্যকরণী। বিহারের জনসংখ্যায় প্রায় ১৮ শতাংশ মুসলমান। বাকি জনসংখ্যা কার্যত হিন্দু, মোট পাঁচ ভাগে বিভক্ত— উচ্চবর্ণ; যাদব ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) বা পিছড়া বর্গ; অতি পিছড়া বর্গ (ইবিসি); দলিত; এবং জনজাতি। হিন্দু ভোটের মধ্যে সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে বেশি ইবিসি, তার পর ওবিসি, দলিত এবং তারও পরে উচ্চবর্ণ। রাজ্য রাজনীতি চালিত হয় এই সংখ্যার হিসাব মাথায় রেখে। এনডিএ-র ভোটব্যাঙ্কের এক দিকে রয়েছে বিজেপির উচ্চবর্ণের সমর্থন-ভিত্তি, আর অন্য দিকে নীতীশ কুমারের ইবিসি ভোট। তার সঙ্গে রয়েছে চিরাগ পাসোয়ানের পাসোয়ান জনভিত্তি। উল্টো দিকে, লালু প্রসাদ যাদবের আমলের যাদব-মুসলমান সমীকরণের পরিধি বিস্তার করতে আগ্রহী তেজস্বী অন্যান্য সম্প্রদায় থেকেও প্রার্থী বেছেছেন। কংগ্রেসও তার প্রদেশ সভাপতি বেছেছে এই সমীকরণের কথা মাথায় রেখেই। এসআইআর-এর মাধ্যমে ভোট চুরি করেছে বিজেপি, এই অভিযোগের পালে হাওয়া কমার সঙ্গে সঙ্গেই বিরোধী রাজনীতি আরও বেশি করে ঢুকে পড়ল জাতপাতভিত্তিক রাজনীতিতে, এই ঘটনাটির পিছনে রয়েছে মহাগঠবন্ধন-এর মূল সমস্যা— জোটস্বার্থকে কখনও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ঠাঁই দিতে না-পারা। বিহারের বিভিন্ন জনসভায় রাহুল-তেজস্বীকে এক সঙ্গে দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু জোটধর্মের খামতিও স্পষ্ট হয়ে উঠছে মাঝেমধ্যেই। বিশেষত, ভোটার অধিকার যাত্রা চলাকালীন যে সম্ভাবনাগুলি তৈরি হচ্ছিল, ভোটের মুখে তা ঝাপসা হয়েছে। বিরোধী পক্ষও শেষ অবধি জাতপাতের রাজনীতির চেনা ছকটির নিরাপদ আশ্রয়ে ঠাঁই নিল।

গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে কেন্দ্রে এনডিএ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বহুলাংশে জেডি(ইউ)-এর উপরে নির্ভরশীল। অন্য দিকে, গত বাজেট থেকেই বিহারের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রসন্ন। এর মধ্যে কেউ কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতেও পারেন। বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণার খানিক আগে অবধিও প্রধানমন্ত্রী বিহারের জন্য কেন্দ্রীয় প্রকল্প ঘোষণা করেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সে রাজ্যে পরিকাঠামো খাতে, শিল্প খাতে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। কিন্তু, এ কথাও একই রকম অনস্বীকার্য যে, প্রধানমন্ত্রী অতীতে বিহারের জন্য যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন, তার তেমন সুফল বিহার পায়নি। বস্তুত, মূলধনি খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি, এবং নাগরিকের জীবনে তার সুফলের মধ্যে ব্যবধান এমনই বিস্তৃত যে, গোটা দেশেই সে ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ হস্তান্তরের নীতি। বিহারও ব্যতিক্রম নয়। ভোটের দিন ঘোষণার ঠিক আগে রাজ্য সরকার এক কোটি কুড়ি লক্ষ মহিলার অ্যাকাউন্টে দশ হাজার টাকা করে পাঠাল— সেটা নাকি তাঁদের ‘ব্যবসা শুরুর প্রাথমিক পুঁজি’। ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফিরলে আরও দেওয়া হবে, তেমন প্রতিশ্রুতিও নিহিত রইল। বিরোধীরাও পিছিয়ে রইলেন না। প্রতিশ্রুতি দিলেন, ভোটে জিতলে ‘যোগ্য’ মহিলাদের প্রতি মাসে আড়াই হাজার টাকা দেওয়া হবে; প্রতি বাড়িতে ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ দেওয়া হবে বিনামূল্যে; পরিবারপিছু এক জনের সরকারি চাকরি হবে। প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের ফারাক মানুষ জানেন। কিন্তু, আজকের ভারত এই নগদ বিতরণের রাজনীতির কুফলও জানে। হাতেগরম টাকার সঙ্গে প্রকৃত উন্নয়নের ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কটি প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিখতে পারে বিহার। দুর্ভাগ্য, শাসক এবং প্রধান বিরোধী জোটের পাশাপাশি শেষ পর্যন্ত এই নগদের রাজনীতির সুরে সুর মেলালেন প্রশান্ত কিশোরও। অন্য প্রশ্নগুলি শেষ পর্যন্ত পড়ে রইল পিছনের সারিতেই।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Assembly Election SIR

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy