Advertisement
E-Paper

ছাত্রের চেহারা

বিদ্যালয়ে সদ্য যোগ দিবার পরই ছাত্ররা যদি শাবল, ডান্ডা লইয়া জবরদস্তি পদত্যাগপত্র লিখিতে বাধ্য করে, মর্মাহত হওয়া ছাড়া শিক্ষকের আর উপায় কী?

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
সানাউল্লা রহমানি

সানাউল্লা রহমানি

মর্মাহত হইয়াছেন শিক্ষক। ছাত্রদের চেহারা দেখিয়া। বিদ্যালয়ে সদ্য যোগ দিবার পরই ছাত্ররা যদি শাবল, ডান্ডা লইয়া জবরদস্তি পদত্যাগপত্র লিখিতে বাধ্য করে, মর্মাহত হওয়া ছাড়া শিক্ষকের আর উপায় কী? দাড়িভিটের স্কুলের সদ্যনিযুক্ত উর্দু শিক্ষক সানাউল্লা রহমানির অভিজ্ঞতার ঝুলিটি এক দিনের চাকুিরতেই ভরপুর। শিক্ষাঙ্গনে তিনি বোমা-গুলি চলিতে দেখিয়াছেন, তাঁহাদের নিয়োগ ঘিরিয়া স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখিয়াছেন, ছাত্রদের তাড়ায় পুলিশকে পলাইতেও দেখিয়াছেন। সর্বোপরি, দাগি আসামির মতো কড়া পুলিশি প্রহরায় কর্মস্থল হইতে ফিরিবার অভিজ্ঞতাটিও তাঁহার হইয়াছে। তাহার পরও পড়াইবার ইচ্ছা থাকিলেই বরং অবাক হইতে হইত।
সানাউল্লা আশ্বস্ত হইতে পারেন, এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁহার একার নহে। সমগ্র শিক্ষককুলের কাছেই রাজ্যের শিক্ষার পরিবেশটি ক্রমশ দুঃস্বপ্নময় হইয়া উঠিতেছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তো বিষময় হইয়াছেই, স্কুলগুলিও আর মুক্ত নহে। এই অবনমনে প্রশাসনের অপদার্থতায় শুধু বিরক্ত লাগে না, পাশাপাশি এক গভীর দুঃখবোধ জাগিয়া উঠে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কটি বর্তমানে কোন অতলে আসিয়া ঠেকিয়াছে। এই সম্পর্ক তো কোনও আইন নির্দিষ্ট করিয়া দেয় নাই। ইহা এক অলিখিত সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের একটি দিক শ্রদ্ধার, অপরটি স্নেহের। শিক্ষককে পিতৃসম জ্ঞান করাই এক কালে ছাত্রদের নিকট স্বাভাবিক ছিল। এই বন্ধনের দৃঢ়তায় নিশ্চিন্ত হইয়া অভিভাবকরাও তাঁহাদের সন্তানের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের দায়িত্বটি নিশ্চিন্তে শিক্ষকের হস্তে অর্পণ করিতেন। কোন মন্ত্রবলে সেই নির্ভরশীলতার বন্ধনটি ছিঁড়িয়া গেল? শ্রদ্ধাপ্রদর্শন দূরের কথা, পশ্চিমবঙ্গের একবিংশ শতকের ছাত্রসমাজ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রবেশ করিয়া শিক্ষকের গালে চড় মারিতে, অশ্রাব্য গালিগালাজ করিতেও দ্বিধাবোধ করে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিক্ষকদের ঘেরাও করিয়া দাবিদাওয়া পেশ করে, পছন্দের শিক্ষক না পাইলে তাঁহার দিকে ঢিল পাটকেল ছুড়িয়া তাড়াইতে চাহে। শিক্ষককুলের বিরুদ্ধে এতখানি অশ্রদ্ধা ছাত্রসমাজের মধ্যে জন্মাইল কী প্রকারে? উত্তরে, দা়ড়িভিটের উর্দুর শিক্ষকের কথাটি তুলিয়া ধরা যায়, কেহ নিশ্চয়ই ছাত্রদের মগজধোলাই করিয়া পাঠাইয়াছিল।
মগজধোলাইয়ের দায়টি বহুলাংশে রাজনীতির। দা়ড়িভিট কাণ্ডে যে প্রত্যক্ষ রাজনীতির কথা বারংবার উঠিতেছে, শুধু সেটুকুই নহে। পশ্চিমবঙ্গের বাতাসে যে রাজনীতি ভাসিয়া বেড়ায়, প্রতিটি প্রশ্বাসে যাহা বঙ্গবাসীর ফুসফুসে প্রবেশ করে, সেই রাজনীতি। এখন প্রতিটি সম্পর্ক, প্রত্যেক অবস্থানই রাজনৈতিক মাপকাঠিতে মাপা হয়। রাজনীতির বাহিরের সামাজিক পরিসরে যে সম্পর্কগুলি ছিল, রাজনীতির বিষক্রিয়ায় তাহারা মরিয়া গিয়াছে। পড়িয়া আছে শুধু রাজনৈতিক হিসাবসঞ্জাত অবস্থান— কে শত্রু আর কে মিত্র, কে সম্মাননীয় আর কে অপমানের যোগ্য, রাজনীতির হিসাবই তাহা স্থির করিয়া দেয়। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য, শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কটিও সেই রাজনৈতিক সংস্পর্শ এড়াইতে পারে নাই। রাজনীতিই শিখাইয়াছে, শিক্ষককে চূড়ান্ত অসম্মান করিয়াও ‘দুষ্টামি’ বলিয়া ছাড় পাওয়া যায়। এই অসামান্য শিক্ষার পর পড়ুয়ারা শিক্ষককে শ্রদ্ধার চোখে দেখিবে কী উপায়ে?

Education Teacher Academics Politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy