Advertisement
০৫ মে ২০২৪
স্কুলে মেয়েদের শারীর শিক্ষার প্রতি আর অবহেলা নয়

চাই আরও অনেক ঝুলন, সাক্ষী, দীপা, সিন্ধু

কিন্তু জিত বা হার, উভয়কেই আপাতত সরিয়ে রেখে মাঝখান থেকে শুধু খেলাটাকে বার করে আনতে পারলে বলা যায়— অলিম্পক্সে দীপা থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ঝুলন— মেয়েদের খেলাকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন, তা আগামীতে আরও সমৃদ্ধ করবার পাশাপাশি তার প্রসার ঘটানোর কাজে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বাড়তে বাধ্য।

স্বাতী গোস্বামী বসু
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৭ ০৭:১০
Share: Save:

দে শের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বকাপ ক্রিকেট ফেরত মহিলা ক্রিকেটারেরা, যোগ্যতার নিরিখে যাঁরা পৃথিবীতে আজ দ্বিতীয়— খবরের কাগজে প্রাণবন্ত ছবিটি দেখে মনে হল, এ রকম ছবি আরও অনেক আগেই দেখবার সৌভাগ্য হওয়া উচিত ছিল ভারতবাসীর। ফাইনালে ঝুলন-মিতালিদের পরাজয়ের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানান টিপ্পনী যেমন ঘোরাফেরা করেছে, তেমনি মানুষ এও বলছেন যে, এগারোটি মেয়ে খেলছে। শপিং মল থেকে বাজার— সর্বত্র মানুষ তা দাঁড়িয়ে দেখছে, কাজের ফাঁকে জেনে নিচ্ছে, স্কোরটা কত! নির্ভয়া-সুজেটদের দেশে এর থেকে বড় প্রতিস্পর্ধী ঘটনা আর কী বা হতে পারত?

কিন্তু জিত বা হার, উভয়কেই আপাতত সরিয়ে রেখে মাঝখান থেকে শুধু খেলাটাকে বার করে আনতে পারলে বলা যায়— অলিম্পক্সে দীপা থেকে ক্রিকেট বিশ্বকাপে ঝুলন— মেয়েদের খেলাকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন, তা আগামীতে আরও সমৃদ্ধ করবার পাশাপাশি তার প্রসার ঘটানোর কাজে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বাড়তে বাধ্য। আবার এ ভাবেও ভাবা যায় যে, মিতালি-ঝুলনদের নিয়ে উৎসাহ-আবেগের যে প্লাবনে ভাসছে গোটা দেশ, সেখানে গাফিলতির আর কোনও জায়গা নেই। ক্রীড়া ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের মেয়েরা ফাইনালে পৌঁছেছে মানেই একেবারে ‘কাপ’ নিয়ে তারা দেশে ফিরবে, এমনটা আশা করবার আগে ভাববার দরকার ছিল, খেলোয়াড় ‘গড়ে’ তুলতে, বিশেষ করে মেয়েদের খেলাতে ‘তৈরি’ করতে রাজ্য বা কেন্দ্র, উভয় সরকারই কতটা আন্তরিক ভূমিকা পালন করে থাকে? আমরা খেলোয়াড় তৈরি করায় নেই, কেবল প্রত্যাশার পারদ চড়াতে আছি, তা কি হয়? আর ক’জন সানিয়া-সাইনা-সিন্ধু-সাক্ষীর মতো মেয়েদের উৎসভূমি হতে পারছে ভারত?

পারছে না তার অন্যতম বড় কারণ, বিদ্যালয়-স্তরের পাঠ্যক্রমে শরীরচর্চা থেকে খেলাধুলো নিদারুণভাবে ব্রাত্য। আজও। সেখানে মেয়েদের খেলার ক্ষেত্রে আবার সামাজিক-ধর্মীয় বিধিনিষেধের বাড়তি গেরো তো আছেই! আসলে এই ভারত তথা বঙ্গসংস্কৃতিতে যেটা হয়ে থাকে, তা হল, ‘লেখাপড়ার ক্ষতি হবে’ জাতীয় ধুয়ো তুলে, আজও আমরা শরীরচর্চা আর খেলাধুলোকে সব্বার আগে জীবন থেকে বাদ দিয়ে থাকি। মেয়েদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা, ‘লোকে কী বলবে’ গোছের কারণ দেখিয়ে দমিয়ে রাখার রেওয়াজ তো বহাল তবিয়তেই আছে! তার ওপর আমাদের স্কুলশিক্ষার পাঠ্যক্রমও শরীরচর্চা তথা খেলাধুলোকে অবহেলা করতেই উৎসাহ দেয়। তা না হলে, ড্রিল থেকে যোগব্যায়াম, অ্যাথলেটিক্স, মার্চিং থেকে অন্যান্য খেলাধুলো— অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদান সংবলিত ‘শারীর শিক্ষা’ বা ফিজিকাল এডুকেশন আমাদের মাধ্যমিক পর্ষদ এবং আইসিএসই বোর্ড অনুযায়ী কেবলমাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তই আবশ্যিক থাকে, আর নবম শ্রেণি থেকে ‘অ্যাডিশনাল’ হয়ে যায়! এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই নিয়ম বহাল আছে। বিদ্যালয়-পড়ুয়াদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায়, বিষয়টিকে ‘ঐচ্ছিক’ বিষয়ের স্তরে রেখে দেওয়া মানে, এর থাকা না-থাকা কার্যত সমতুল। মনে রাখতে হবে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় ‘অ্যাডিশনাল’ এখন গুটিকতক ছেলেমেয়েই নেয়, কারণ এর থেকে প্রাপ্ত নম্বর মোট নম্বরকে প্রভাবিত করে না! আইসিএসই-তে বোর্ড পরীক্ষায় ‘অ্যাডিশনাল’ নিতেই হয়, কিন্তু বিশেষ করে মেয়েদের স্কুলগুলোতে, ‘শারীর শিক্ষা’ নেওয়ার সুযোগ আদৌ থাকবে কি না, সেটা সম্পূর্ণভাবে স্কুল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত।

স্কুল শিক্ষার ক্ষেত্রে, আমরা শিশুর ‘সার্বিক বিকাশ’-এর কথা বলে থাকি। শুধুই পড়াশুনো দিয়ে নিশ্চয় সেই বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়? তা হলে, স্কুলশিক্ষা পর্ষদগুলি কি মনে করছে, অষ্টম শ্রেণির মধ্যেই সেই বিকাশ কার্যত সম্পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে, তাই ক্লাস নাইন-এ গিয়ে সে সবের আর প্রয়োজন নেই? এ ক্ষেত্রে সিবিএসই বোর্ড অবশ্য গুটিগুটি এক ধাপ এগিয়েছে। লম্বা সময় ধরে অপাঙ্‌ক্তেয় থাকা শারীর শিক্ষার পরীক্ষা, ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে, ‘বাধ্যতামূলক’ করা হয়েছে। তবে এখানেও প্রশ্ন একটা থেকেই যাচ্ছে। কারণ, এই বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরটি কেবলমাত্র ‘গ্রেড’ হিসেবে মার্কশিটে উল্লিখিত থাকবে, মোট নম্বরের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক থাকবে না! এখন প্রশ্ন, তা হলে শুধুমাত্র মার্কশিটের শোভাবর্ধনের জন্যে অকারণ এই আয়োজন কেন? তবু, নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল।

এ বার আরও একটি ঘোরতর সত্যি কথায় আসি। শৈশব থেকে শুরু হয় যে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। এও ঠিক যে, প্রাথমিক স্তর থেকে শিখে আসা কোনও বিদ্যা হঠাৎ করে মাঝপথে থেমে গেলে বা আবশ্যিক বিষয় ঐচ্ছিক হয়ে গেলে, আট বছর ধরে চর্চিত বিদ্যার ফল স্রেফ মাঠে মারা যায়! আমাদের দেশে দশকের বেশি সময় ধরে ঠিক এই অসুখেই আক্রান্ত শারীর শিক্ষা, চলতি ভাষায়, পিটি। অথচ, আমেরিকা, ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে তো বটেই, এ দিকে সিঙ্গাপুর বা জাপান— সর্বত্র বিদ্যালয় স্তরে বিষয়টির চর্চা আবশ্যিক।

মাধ্যমিক স্তরে শরীরচর্চা এবং খেলাধুলোকে অবহেলা করা মানে, বয়ঃসন্ধির সময়ে ছেলেমেয়েদের মন ও শরীরের টানাপড়েনকেও উপেক্ষা করা। আজকে শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ঘরে ঘরে ছেলেমেয়েদের মধ্যে দানা বাঁধা জুভেনাইল ডায়াবিটিস, থাইরয়েড, ওবিসিটি, সাইবার অ্যাডিকশন-এর প্রকোপ, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে (বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে) ইদানীং কালের ভয়াবহ আকার নেওয়া টিভি সিরিয়াল দেখার নেশা থেকে সঞ্জাত মানসিক অবক্ষয়ের মোকাবিলায় চুটিয়ে শরীরচর্চা, যোগাভ্যাস, ঝাঁপিয়ে পড়ে খেলাধুলো, বিশেষ করে, আউটডোর গেমস-এর যে জুড়ি নেই, তা আমরা জানি বটে, মান্য করি না।

প্রত্যক্ষভাবে স্কুলশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে প্রথমেই বলি যে, অন্তত মাধ্যমিক পর্যন্ত শারীর শিক্ষাকে আবশ্যিক রাখলে ছাত্রছাত্রীদের ওপর মোটেই তা কোনও প্রকার বাড়তি চাপের কারণ হবে না। বরং শ্রেণিকক্ষের চার দেওয়ালের আবর্তে ক্লাসের পর ক্লাস করবার পরে, সপ্তাহে একটি বা দুটি পিটি ক্লাস তাদের শুধু খোলা আকাশের নীচে ফুসফুস ভরে দম নেওয়ার সুযোগই দেবে না, বই-নির্ভর পাঠ্যক্রমের হাত থেকে ক্ষণিকের মুক্তি পরবর্তী ক্লাসগুলোর জন্যে বা বাড়িতে ফিরে দিনের বাকি কাজের জন্যে তাদের উজ্জীবিতই করবে। এক জন মাস্টারমশাই আক্ষেপ করছিলেন, আগে ছেলেমেয়েরা অন্তত কাবাডি বা খোখো খেলাগুলো জানত। এখন সেটাও জানে না।

শারীর শিক্ষার প্রত্যাবর্তনে মেয়েদের বাড়তি সুবিধা হবে এই যে, নাইন-টেন মানে উঁচু ক্লাস, অর্থাৎ বাড়িতে হুকুম জারি হওয়া যে— ‘এখন থেকে খেলা কম, কাজ (লেখাপড়া) বেশি’, এই রোগটা হয়তো কমবে। আবার বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছলেই বহু মেয়ের, স্কুল বাদে, বাড়ির বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়া শুরু হয়। গ্রামাঞ্চলে এ-ও বাস্তব যে, বিদ্যালয়-ফেরত বাড়িতে ঢোকা মানে টিভি, নয় কম্পিউটারের সামনে মুখ গুঁজে বসে পড়া। ছেলেরা বাড়ি ফিরে তবু খেলতে যাওয়া বা সাইকেল নিয়ে খানিক ঘুরে আসার সুযোগ পায়। মেয়েরা অনেক সময় বাড়ির বিধিনিষেধের জালেই আটকে থকে। এ ক্ষেত্রে শারীর শিক্ষা বা পিটি ক্লাসের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শহরাঞ্চলে তবু মায়েরা ইদানীং মেয়েদের ব্যাডমিন্টন-টেনিসে নিয়ে যাচ্ছেন। নাচের ক্লাস তো ছিলই। গ্রামাঞ্চলে কিন্তু বহু বহু বাড়িতে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে, মেয়েদের নাচ শেখার ক্ষেত্রেও হাজারটা বারণ। এ-দিকে শৈশব-চুরি নিয়ে এত শোরগোল, অন্য দিকে বয়ঃসন্ধিতেই বলছি, খেলাধুলোয় লাগাম টানো!

শারীর শিক্ষায় গুরুত্ব দিলে স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের যে দারুণ উপকার হবে, তাতে সন্দেহমাত্র নেই। গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরেরও বহু মেয়ের একমাত্র স্কুলেই খানিক শরীরচর্চার অবকাশ থাকে। খেলাধুলো হল বাড়তি পাওনা। এতে আরও একটা লাভ হবে এই যে, কোনও ছাত্রীর ক্রীড়াতে আলাদা ভাল-লাগা আছে কি না বা তার মধ্যে সেই রকম ট্যালেন্ট আছে কি না, তা বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের শিক্ষিকার জানা হয়ে যাবে। বেছে নেওয়া যাবে আগামী দিনের দীপা এবং ঝুলনদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education Health Physical Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE