Advertisement
১২ অক্টোবর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

আত্মঘাতী চাষির খোঁজে

অতিরিক্ত চড়া সুদে অতিরিক্ত ধার করে শেষে আত্মহত্যা, এই সংকটে ভুগছেন সব ধরনের চাষি। অন্য রাজ্য অন্তত সেটা স্বীকার করে। ক্ষতিপূরণ দেয়, বিমার ব্যবস্থা করে। পশ্চিমবঙ্গ চাষির আত্মহত্যাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে।শে  ষ শ্রাবণের বর্ধমান। চাষিকে পথে বসিয়ে এখন রূপ দেখাচ্ছে বেহায়া আকাশ। ফাঁপানো মেঘ, গিল্টি-করা রোদ, ফিচেল বৃষ্টি। উপরমহলে যখন এমন নির্লজ্জ উৎসব, নীচে তখন ঢিবি-ভাঙা পিঁপড়ের মতো চাষিদের ছোটাছুটি। পুরুষ-মেয়েরা মাথায় করে, ভ্যানরিকশা করে ধানের চারার বান্ডিল বয়ে এনে ফের পুঁতছেন জমিতে। পলিথিনের নীচে আবার তৈরি করছেন সব্জির চারা।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

শে  ষ শ্রাবণের বর্ধমান। চাষিকে পথে বসিয়ে এখন রূপ দেখাচ্ছে বেহায়া আকাশ। ফাঁপানো মেঘ, গিল্টি-করা রোদ, ফিচেল বৃষ্টি। উপরমহলে যখন এমন নির্লজ্জ উৎসব, নীচে তখন ঢিবি-ভাঙা পিঁপড়ের মতো চাষিদের ছোটাছুটি। পুরুষ-মেয়েরা মাথায় করে, ভ্যানরিকশা করে ধানের চারার বান্ডিল বয়ে এনে ফের পুঁতছেন জমিতে। পলিথিনের নীচে আবার তৈরি করছেন সব্জির চারা। বাড়তি খরচ, বাড়তি পরিশ্রমেও অনেক দেরিতে, অনেক কম পরিমাণ ফসল মিলবে। তবু মাথায়-পিঠে বৃষ্টি নিয়ে চারদিকে বাঁচার মরিয়া চেষ্টা। তার মাঝে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করতে হল, চাষি মরে কেন?
উত্তরের খোঁজ শুরু করা চলে হরগোবিন্দপুরে, যেখানে সুশান্ত রুইদাসের বাড়ি। জামালপুর ব্লকের সহ-কৃষি অধিকর্তা জানালেন, সুশান্ত রুইদাস মদ খেতেন বলে ছেলেদের সঙ্গে অশান্তি লেগেই থাকত। এক দিন মা বাড়ি ছিল না, সেই সুযোগে ফুচকা-বিক্রেতা ছেলেরা বাপকে পেটায়। অভিমানে আত্মহত্যা করেন জামালপুর ব্লকের হরগোবিন্দপুরের বছর পঁয়তাল্লিশের সুশান্ত। নিজে গ্রামে গিয়ে ও স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়ে এমনই তিনি লিখেছেন রিপোর্টে।
সুশান্তের স্ত্রী পূর্ণিমা তাঁদের ইট-গাঁথা দেওয়াল, টিনের চালের বাড়ির দাওয়ায় বসে বলছিলেন, পটল খেতে জল জমেছে দেখেই মুষড়ে পড়েছিল লোকটা। অনেক ধার হয়েছিল কিনা। কত ধার, প্রশ্ন করতেই গুটিয়ে গেলেন পূর্ণিমা। ঘিরে-থাকা প্রতিবেশীরা বলতে লাগলেন, ‘‘না না, ও সব ওরা কিছুই জানে না।’’
যার কাছে তাঁর ধার, সেই তারক সাহানা ছিপছিপে যুবক, প্রায় ৪৭ বিঘা জমির মালিক। নিজে চাষ করেন ২০ বিঘে, বাকিটা ঠিকায় দিয়েছেন আট জন চাষিকে। তাঁদেরই এক জন সুশান্ত রুইদাস। এক মরসুম থেকে অন্য মরসুম, এক বছরের জন্য জমি নিয়েছিলেন। শীতে আলু মার খেয়েছে। বর্ষায় ১০ কাঠা জমিতে বাদাম, ১০-১৫ কাঠা জমিতে পটল বসিয়েছিলেন। বাদাম বীজ, পটলের কীটনাশক, লেবার খরচ, সবই ধারে। কেবল তারকের কাছেই ১৫ হাজার টাকার বেশি দেনা সুশান্তর, সব মিলিয়ে তার ডবল তো হবেই। টানা বৃষ্টিতে বাদামের কল বেরিয়ে গিয়েছে, অর্ধেক খেত থেকে তোলাই যায়নি। পচেছে পটল। ঠিকা চাষিদের ঢেঁড়শ, লঙ্কা সব নষ্ট হয়েছে, বললেন তারক।

ভাতাড়ের সোনা দাসও আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর জমি ছিল বিঘে পাঁচেক, ঠিকা নিয়েছিলেন তিন বিঘে, আর ভাগে চাষ করছিলেন দু’বিঘে আট কাঠা। তাঁর পরিবারও বলছে, বোরো ধান শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হয়েছে, যা ধান উঠেছিল তা মাত্র ৪০০-৪৩০ টাকা বস্তা (৬০ কেজি) দরে বিক্রি করতে হয়েছিল। মহাজনের কাছে হাজার দশেক টাকা, সারের আড়তদারের কাছে সাত হাজার টাকা বাকি, জলের দাম, লেবারের টাকা বাকি, ঘরের সোনা বন্ধক দেওয়া আছে।

সরকার বলছে, সুশান্ত, সোনা, তাঁদের মতো আলু, ধান চাষিরা মারা গিয়েছেন পারিবারিক অশান্তিতে। নইলে ছ’কাঠা কি আড়াই বিঘের ফসল কতটুকু? তার উপর নির্ভর করে কে-ই বা বাঁচতে পারে, যে তার জন্য মরতে যাবে?

ভাতাড়, জামালপুরের গ্রামে গ্রামে কথা বলে দেখা গেল, যে চাষির জমি নেই, বা সামান্য জমি, চাষ করতে গিয়ে তাঁর ঋণের বোঝা বড় সামান্য হয় না। ধরা যাক হরগোবিন্দপুরের কথাই। গ্রামে কেবল চার-পাঁচ ঘর আছেন, যাঁদের জমি ১০ বিঘার বেশি। শ’দুয়েক পরিবারের জমি দু’তিন বিঘে, আরও আড়াইশো পরিবার জমিহীন, খাতায়-কলমে খেতমজুর। কিন্তু সরকারি নথি, ব্যাঙ্ক-সমবায়ের খাতা, আর চাষের জমির হিসেব এক নয়। সুশান্তের মতো যাঁদের জমি নেই, বা সোনা দাসের মতো অতি সামান্য জমি, সেই খেতমজুর বা প্রান্তিক চাষি মুখের চুক্তিতে জমি ঠিকা নিয়ে চাষ করেন। মূলধন বলতে কায়িক পরিশ্রম। খরচ-মুনাফার হিসেব করতে গিয়ে যার কোনও মূল্য এঁরা ধরেন না। সরকারি খাতায় এঁরা জমির মালিকও নন, বর্গাদারও নন, ভাগচাষিও নন। ‘চাষি’ স্বীকৃতি না পাওয়ায় চাষিদের জন্য সরকারের যা কিছু সুযোগসুবিধে— সামান্য সুদে ঋণ, ভর্তুকিতে সার-বীজ, ট্র্যাক্টর বা পাওয়ার টিলারের মতো যন্ত্র কেনার অনুদান, ফসলের সরকারি সহায়ক মূল্য— কিছুই এদের জোটে না। উল্টে ঋণ নিতে হয় মহাজনি সুদে, মালপত্র বাজার থেকে কিনতে হয় বেশি দামে, আর ফসল বিক্রি করতে হয় বাজারদরের কম দামে।

কত বেশিতে কেনা? কত কমে বিক্রি? ঠিকাচাষির চাষবাস নিয়ে কথা হচ্ছিল ভাতাড়ের কালীটিকুরি গ্রামের এক চাষিবাড়ির দাওয়ায়। চাষিরা জানালেন, বোরো মরসুমে বিঘে-প্রতি ৩ হাজার টাকা, আমনে ৪ হাজার টাকা দিতে হয় জমির মালিককে। মহাজনি সুদ খাতায়-কলমে ১৬ শতাংশ, হিসেব হয় প্রধানত মালের নিরিখে। সারের আড়তদার (তথা মহাজন) ধারে সার দেয় বাজারের চাইতে বস্তায় (৫০ কেজি) ২০ টাকা বেশিতে। ধান উঠলে মাঠ থেকে কিনে নেয় বাজারদরের চাইতে বস্তায় (৬০ কেজি) ২০ টাকা কম দিয়ে। বীজের হিসেবও হয় সে ভাবেই। বাজারদরে কিনতে হয় জল, লেবার। এ ছাড়া রয়েছে বন্ধকীতে ধারের কারবার। ‘‘এক ভরি সোনার ২৫ হাজার টাকা বাজারদর, আপনাকে দেবে ১০ হাজার টাকা, আবার মাসে ১০ শতাংশ সুদ নেবে,’’ বললেন শেখ মফিজুল হক। বন্ধকী কারবার আবার গোপনীয়। পাঁচকান হলেই আর মিলবে না ধার। অথচ ধার করে বীজ, সার, কীটনাশক, মজুরি, জল, ট্র্যাক্টর ভাড়া, সব বিনিয়োগ ঠিকাচাষির। সবই মুখচুক্তি।

কথা চলছে, আর ঘন ঘন চোখ মুছছেন বাড়ির বিধবা মালকিন। তাঁর ছেলে সবর মোল্লা মাত্র ১৮ বছর বয়সে কীটনাশক খেয়েছিল। চাষ করতে গিয়ে ৫০-৬০ হাজার টাকা ধার করে ফেলেছিল বাপ-মরা ছেলে। সুদ মেটাতে ফের ধার করে করে শেষে আর সামলাতে পারেনি। তখন গ্রামে অনেক রিপোর্টার এসেছিল। কে কী লিখেছে তাঁরা জানেন না, কিন্তু আজও কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পায়নি পরিবার।

অতিরিক্ত চড়া সুদে অতিরিক্ত ধার করে ফেলে শেষে আত্মহত্যা, এই সংকটে ভুগছেন সব ধরনের চাষি। এই শ্রাবণেই আরামবাগের লক্ষ্মীকান্ত পাশাড়ি ১২ বিঘে জমির মালিক হয়েও ঋণের বোঝা (ব্যাঙ্কের কাছে ১ লক্ষ, সমবায়ের কাছে ৬০-৭০ হাজার, সার-জল-লেবারের ধার) সামলাতে না পেরে বিষ খেয়েছেন। ‌ কেন্দ্রীয় কৃষি মন্ত্রক গত জুন মাসে জানিয়েছে, গত তিন বছরে এ দেশে আত্মহত্যা করেছেন ৩৩১৩ চাষি। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বড় চাষি-ছোট চাষি, জমির মালিক-ভূমিহীন ঠিকাচাষি, তুলো-ভ্যানিলার মতো দামি ফসলের চাষি থেকে পটল-তিলের মতো সস্তার ফসলের চাষি, সব ধরনের চাষিই ঋণে সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছে। চাষি বন্যা, খরা, বাজারের ওঠা-পড়ায় মরে না। চাষি মরে ঋণে।

অন্য রাজ্য অন্তত সেটা স্বীকার করে। পঞ্জাব আত্মঘাতী চাষির পরিবারকে তিন লক্ষ টাকা দেয়, অন্ধ্র প্রদেশ দেয় দেড়-দু’লক্ষ টাকা, মহারাষ্ট্র ৫ লক্ষ টাকা বিমা পলিসি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ যে চাষির আত্মহত্যাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে, সে কি কেবল ক্ষতিপূরণ এড়ানোর জন্য? যে রাজ্য চোলাই মদ খেয়ে মরলেও ২ লক্ষ টাকা দেয়, ক্লাবকে দেয় ২ লক্ষ, সেখানে টাকা বাঁচানো খুব বড় কথা মনে হয় না। তবে কি ৯০ শতাংশ চাষিকে কিষাণ ক্রেডিট কার্ড পৌঁছে দেওয়ার সরকারি রূপকথা টোল খেয়ে যাওয়ার ভয়? বহু চাষিকে যে আজও মহাজনি সুদ নিতে হয়, সে সত্য ঢাকতে চাষিমৃত্যুর ব্যাখ্যায় বাড়ির ঝগড়ার গল্প ফাঁদা?

হয়তো এই পাইকারি অস্বীকৃতি আসছে আরও গভীর কোনও ভয়, অস্বস্তি থেকে। এ রাজ্যের গ্রামে যে এক শ্রেণির চাষি তৈরি হয়েছে, যাঁরা চাষের সমস্ত ঝুঁকি বহন করেন, কিন্তু চাষিদের প্রাপ্য সরকারি নিরাপত্তার কুটোটিও পান না, সে সত্যটা সরকারের পক্ষে অস্বস্তিকর। আজ যদি সরকার উদারতা দেখিয়ে কৃষিঋণ মকুব করে, কিংবা বিমা কোম্পানি ফসলের ক্ষতিপূরণ দিতে মাঠে নামে, তাতে ৩০-৫০ শতাংশ চাষির কানাকড়িও লাভ হবে না। চাষের শ্রমের সঙ্গে জমির সত্বের দূরত্ব যে বেড়ে চলেছে, এটা বাম-তৃণমূল, দু’পক্ষের কাছেই মারাত্মক। তাই শাসক বা বিরোধী, খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে-থাকা ঠিকাচাষিদের কথা কেউ মুখেও আনছেন না।

(চলবে)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE