Advertisement
E-Paper

না বলা বাণী

প্রণববাবু অনেক ইতিহাস বলিলেন, অথচ যে নেত্রীর রাজনীতি-ছত্রের ছায়ায় তিনি আজীবন আশ্রয় পাইয়াছেন, সেই ইন্দিরা গাঁধীর নামটিও উচ্চারণ করিলেন না?

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৮ ০০:০২

একটি সম্ভাবনা নষ্ট হইল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সদর দফতরে যাওয়ার আমন্ত্রণটি যখন প্রণব মুখোপাধ্যায় গ্রহণ করিয়াছিলেন, তখন এই সম্ভাবনা তৈরি হয় যে, তিনি পেরেককে পেরেক বলিবার সুযোগটি ছাড়িবেন না। কিন্তু বাস্তবে তাহা ঘটিল না। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেস দলের দীর্ঘ দিনের অন্যতম নীতি-কান্ডারি প্রণববাবু নাগপুর সফর সারিলেন, কিন্তু সেই সফরে আরএসএস-কে তাঁহার যে বার্তা দিবার প্রত্যাশা নাগরিকের মনে ছিল, তাহা মিটিল না। না তাঁহার বক্তব্যে, না তাঁহার আচরণে। তিনি বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত হইয়াছিলেন, সেটুকু সারিয়াই চলিয়া আসিতে পারিতেন। কিন্তু তিনি গোটা অনুষ্ঠান চলাকালীন সভাস্থলে উপবিষ্ট থাকিলেন, সঙ্ঘ সদস্যদের ক্রিয়াকর্ম অবলোকন করিলেন, আরএসএস প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের বাসভবন ঘুরিয়া দেখিলেন এবং সেখানে দর্শকের মন্তব্য-নথিতে হেডগেওয়ারকে— আরএসএস প্রতিষ্ঠাতাকে— ‘ভারতমাতার মহান সন্তান’ আখ্যায় ভূষিত করিলেন! অনুমান করা যায়, আরএসএস যে আশায় এই বর্ষীয়ান নেতাকে নিজেদের দুর্গে আহ্বান করিয়াছিল, তাহা তো পূর্ণ হইলই, কিছু উপরিও মিলিল। সত্য বটে, ‘বহুত্ববাদ’ ও ‘সহিষ্ণুতা’র সারস্বত আহ্বানটি উচ্চারণ করিয়াছেন প্রণববাবু। তাঁহার বক্তৃতায় জ্ঞান ও চিন্তার বিস্তার আছে, গভীরতাও। কিন্তু বহুশ্রুত এবং তাঁহার নিজেরই বহু-উচ্চারিত কিছু জ্ঞানের কথা শুনাইবার জন্যই কি তিনি হেডগেওয়ারের অনুগামীদের আমন্ত্রণ স্বীকার করিয়াছিলেন?

কংগ্রেস নেতৃত্ব আপাতত প্রণববাবুর বক্তৃতা ও কাজকর্মের নানাবিধ ব্যাখ্যা দিতে অতি ব্যস্ত। প্রণববাবুর কথা শুনিয়া অতঃপর আরএসএস আত্মশুদ্ধির পথে হাঁটিবে কি না— এমন প্রশ্নও দলের মুখপাত্রের মুখে ধ্বনিত হইয়াছে। লজ্জা ঢাকিবার এই মরিয়া চেষ্টা করুণ এবং হাস্যকর। সঙ্ঘের শ্রোতৃমণ্ডলীর প্রত্যেকেরই দুইখানি কান আছে, সেই দুইটির যথাযথ ব্যবহার করিয়া কী ভাবে প্রণববাবুর রুটিনদুরস্ত নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার বাণীমালার মোকাবিলা করিতে হয়, তাহাও তাহারা জানে। বস্তুত, সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত এই বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশই রাখেন নাই। অনুষ্ঠান শেষ হইতে না হইতে তিনি বলিয়াছেন: কিছুই পাল্টাইবে না, আরএসএস-ও আরএসএস থাকিবে, প্রণব মুখোপাধ্যায়ও প্রণব মুখোপাধ্যায়ই থাকিবেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।

প্রথম হইতেই প্রশ্ন উঠিয়াছিল, প্রণববাবুর এই সফরের আদৌ কী প্রয়োজন ছিল? আমন্ত্রণ বস্তুটি তো আদেশ নহে, যাহা ফিরাইয়া দেওয়া যায় না! কিন্তু আমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেনই যদি, তবে আরএসএস-এর মঞ্চে গিয়া কেন ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ লঙ্ঘন করিয়া আসিবার কারণে তাহাকে সরাসরি তিরস্কার করিবেন না? বিশেষত, গাঁধী-হত্যার প্রসঙ্গটি সম্পূর্ণ অনুক্ত রাখিবেন? আরএসএসের মঞ্চে দাঁড়াইয়া সহিষ্ণুতার জয়গান করিলেন, অসহিষ্ণুতার সমালোচনা শুনাইলেন, অথচ ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারির কথা উচ্চারিত হইল না— কেন? ঠিক তেমনই, প্রণববাবু অনেক ইতিহাস বলিলেন, অথচ যে নেত্রীর রাজনীতি-ছত্রের ছায়ায় তিনি আজীবন আশ্রয় পাইয়াছেন, সেই ইন্দিরা গাঁধীর নামটিও উচ্চারণ করিলেন না? কেন? এই সব প্রসঙ্গ শুনিলে নাগপুরের উদ্যোক্তারা ক্ষুণ্ণ হইবেন বলিয়া? কিন্তু যদি অপ্রিয় কথাই না শুনাইবেন, তবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের অনুষ্ঠানে হাজির হইবার আর কী যুক্তি থাকিতে পারে? দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ রাজনৈতিক জীবনের পরে, ভারত-রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসন অলঙ্কৃত করিবার পরে আর কোনও জাগতিক প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষার কথা নিশ্চয়ই উঠিতে পারে না! প্রণব মুখোপাধ্যায়কে লইয়া আজ এই অপ্রিয় কথাগুলি আলোচিত হইতেছে, ইহা দুর্ভাগ্যজনক।

Pranab Mukherjee Mohan Bhagwat RSS Congress প্রণব মুখোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy