সেতু ভাঙিলে বুদ্ধি বাড়ে। পোস্তার উড়ালপুল বিপর্যয়ের পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী দেশের সমস্ত সেতু ও উড়ালপুলের স্বাস্থ্য যাচাই করিবার নির্দেশ দিয়াছেন। রাজ্য সরকারও স্থির করিয়াছে, কলিকাতা ও সন্নিহিত এলাকায় সাম্প্রতিক কালে নির্মিত বিভিন্ন উড়ালপুলের মান পরীক্ষা করিবার দায়িত্ব কোনও নির্ভরযোগ্য সংস্থাকে দেওয়া হইবে। দিল্লি গত কাল যাহা ভাবিয়াছে, কলিকাতা আজ তাহা ভাবিতেছে, এমন কথা বলিলে তাহা হইবে অর্ধসত্য। তিন বছর আগে উল্টোডাঙার ফ্লাইওভার ভাঙিবার পরেও রাজ্য সরকার শহরের ফ্লাইওভারগুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষার আশ্বাস দিয়াছিল। পরীক্ষা শুরু হইয়াছিল কি না, দেবা ন জানন্তি। নূতন প্রস্তাবের পরিণতি প্রথম প্রতিশ্রুতির অনুরূপ হইবে না, তাহার কোনও নিশ্চয়তা নাই, বিশেষত শিয়রে যখন নির্বাচনী মহা-হট্টগোল। তুলনায় কেন্দ্রীয় উদ্যোগটির উপর ভরসা বেশি, বিশেষত নিতিন গডকড়ীর সম্পর্কে অন্তত একটি ভাল কথা সুবিদিত— তিনি কাজের লোক।
কিন্তু বুদ্ধি বাড়িবার জন্য সেতুভঙ্গের প্রয়োজন হইবে কেন? পরিকল্পনা ও নির্মাণ হইতে শুরু করিয়া রক্ষণাবেক্ষণ অবধি প্রতিটি পর্যায়ে যে কাজ স্বাভাবিক নিয়মেই হইবার কথা, তাহার জন্য বিশেষ আয়োজন করিতে হয় কেন? কারণ দুই প্রকার: অপদার্থতা এবং দুর্নীতি। একটি অন্যটিকে প্রশ্রয় দেয়, যে অপদার্থ সে স্বাভাবিক নিয়মে সুযোগ পায় না বলিয়াই দুর্নীতির আশ্রয় লয়। এখানেই প্রশাসনের দায়িত্ব। দায়িত্বও দুই প্রকার: দক্ষতাকে তাহার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দেওয়া। একটি মৌলিক শর্ত পূরণ করিলেই এই দুইটি দায়িত্ব নির্বাহ করা সম্ভব, বস্তুত সহজ। তাহা হইল, নিয়ম মানিয়া চলা। ব্রিটিশ উত্তরাধিকার এবং ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের যৌথ আশীর্বাদে এ দেশে আইনের ঘাটতি নাই, বরং উদ্বৃত্ত। প্রশাসকরা আইনের শাসন মানিয়া চলিলে রাস্তার গুণমানও ঠিক থাকে, উড়ালপুলও ভাঙিয়া পড়ে না।
কিন্তু রাজ্য চালাইবার অধিকার যথেচ্ছাচারের অধিকারে পরিণত হইলে আইনের শাসন অন্তর্হিত হয়, তাহার স্থান লয় দুরাচার, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ। তখন অপটু সংস্থাকে সেতু বা উড়ালপুল নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয়, অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয় যাহাতে তাহারা শাসকের পছন্দসই ঠিকাদারকে কাজের বরাত দেয়, ঠিকাদারের উপরও পরবর্তী পর্যায়ে অনুরূপ চাপ আসে। চেনাজানা এবং/অথবা লেনদেনের সুবাদে ‘কাজ পাওয়াইয়া দেওয়া’র ব্যবসায় সেতুর নকশা, যন্ত্রপাতি বা মালমশলায় ভেজাল হইতে শুরু করিয়া নাটবল্টু ঝালাই করিয়া ‘কাজ চালাইয়া দেওয়া’র ভয়াবহ দুর্বুদ্ধিও স্বাভাবিক হইয়া দাঁড়াইতে পারে। এমনকী, যে সংস্থা নির্মাণের বরাত পাইয়াছে, কার্যত তাহাকেই তদারকির দায়িত্ব দেওয়ার মতো বিপজ্জনক অন্যায়ও দিব্য চলিতে পারে। পোস্তার উড়ালপুলটির ক্ষেত্রে বিবিধ অভিযোগ প্রবল। আইনের চোখে সত্যাসত্য তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির কটুগন্ধ এতটাই তীব্র এবং পরিব্যাপ্ত, সিন্ডিকেট নামক ডাকাতদলের প্রতাপ এমনই সর্বগ্রাসী ও প্রকাশ্য যে, বিপর্যয়ের কার্যকারণসূত্রগুলি অনুমান করা কঠিন নহে। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকরা নির্বোধ নহেন, দুঃশাসন কোথায় পৌঁছাইয়াছে তাঁহারা বিলক্ষণ জানেন। গণতন্ত্রে দুঃশাসককে শাস্তিদানের প্রকৃষ্ট আয়ুধ— নির্বাচনে পরাজিত করা। নাগরিকরা সেই অস্ত্র প্রয়োগ করিবেন, না নির্লজ্জ অনাচার ও দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দিয়া নিজেদের সর্বনাশের পথ আরও প্রশস্ত করিবেন, তাহা স্থির করিবার পক্ষে ইহাই মাহেন্দ্রক্ষণ। আজ বিধানসভা নির্বাচন শুরু হইতেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy