Advertisement
১০ মে ২০২৪
চিনের শিনজিয়াং প্রদেশে উইগুরদের যন্ত্রণা ক্রমশ বাড়ছে

সংখ্যালঘুর বিপদ

শোনো হে, ওই হান-চিনা পরিবার তোমাদের বাড়ির ছেলেকে দত্তক নেবে। এখন থেকে তোমাদের ছেলে হবে ওদের ছেলে। আর হ্যাঁ, যদি হান-চিনাদের সঙ্গে তোমাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দাও, তবে দশ হাজার ইউয়ান পুরস্কার। হাতে হাতে।

আন্তর্জাতিক: উইগুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে চিনা সরকারের কীর্তিকলাপের প্রতিবাদ। প্যারিস, ২৫ মার্চ ২০১৯। এএফপি

আন্তর্জাতিক: উইগুরদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে চিনা সরকারের কীর্তিকলাপের প্রতিবাদ। প্যারিস, ২৫ মার্চ ২০১৯। এএফপি

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

আয়শে, আজ থেকে তোমার নাম কিম লি। সাদাম, তুমি হবে চেং হুই।— আজ্ঞে, বলেন কী হুজুর! বাপ-ঠাকুরদার দেওয়া নাম, পাল্টে নেব!— নেবে। নিতে হবে। এটাই নিয়ম।

শোনো হে, ওই হান-চিনা পরিবার তোমাদের বাড়ির ছেলেকে দত্তক নেবে। এখন থেকে তোমাদের ছেলে হবে ওদের ছেলে। আর হ্যাঁ, যদি হান-চিনাদের সঙ্গে তোমাদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে দাও, তবে দশ হাজার ইউয়ান পুরস্কার। হাতে হাতে।

ভাইসকল, চলো আমরা নতুন শিক্ষা কেন্দ্রে যাই। সেখানে শিখে নেবে খাঁটি চিনাদের মহান ঐতিহ্য, তাদের রীতিনীতি, তাদের বিশ্বাস। সে সব আপন করে নেবে। তোমরা তোমাদের বিষয়ে এত দিন যা জানতে ভুল জানতে। এ বার তাই তোমাদের জন্য আমরা ‘রি-এডুকেশন ক্যাম্প’ বসিয়েছি।

— চিন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে শিনজিয়াং প্রদেশের উইগুর সম্প্রদায়ের। ওই প্রদেশে তাঁদের সংখ্যা এখন কোটিখানেক। বেশ কিছু বছর ধরে এই উইগুরদের চিনা ‘মূলস্রোত’-এ মিশিয়ে দিতে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছেন বেজিংয়ের কর্তারা।

কিন্তু কেন? কারণ, উইগুররা আলাদা। আদিতে তুর্কি, ধর্মে মুসলমান এই মানুষগুলির ভাষা, রীতিনীতি, পোশাক, লোকাচার, সবই হান-চিনাদের থেকে একেবারে আলাদা। আপাতদৃষ্টিতে সেটা দেশের শাসকরাও মানেন। তাঁদের প্রদেশটির নামই হল শিনজিয়াং উইগুর অটোনমাস রিজন। কিন্তু তিব্বতের মতোই, স্বশাসন নামেই। অনেক দিন ধরেই অঞ্চলটি আষ্টেপৃষ্ঠে চিন-শাসিত। স্বাভাবিক ভাবেই উইগুররা এই শাসন পছন্দ করেন না। তাঁরা চির কাল নিজেদের মতো থাকতে চেয়েছেন। এবং পার্টির নেতাদের কাছে সেই স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষাই হল বিদ্রোহের শামিল। তার ওপর তাঁদের কিছু মানুষ উগ্রপন্থী হিসেবে অভিযুক্ত, তাঁদের নামে চিনের মূল ভূখণ্ডেও নাশকতামূলক কাজের অভিযোগ উঠেছে। ২০০৯ সালে শিনজিয়াংয়ের রাজধানী উরুমছি’তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শ’দুয়েক হান-চিনার মৃত্যুর পরে চিন সরকার ঠিক করে, শিনজিয়াংয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করবে। তার ওপর আবার এই প্রদেশের সঙ্গে আটটি দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। সুরক্ষা, বাণিজ্য এবং বাকি মহাদেশের ওপর নজরদারি ও দখলদারির প্রয়োজনে এই প্রদেশ চিনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাকে ষোলো আনা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতেই হবে।

অতএব দমন নীতি। সে নীতি চলছে অনেক দিন ধরেই। আশির দশক থেকে একাধিক বার একটা না একটা প্রতিবাদ বা বিক্ষোভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিনজিয়াংয়ে সরকারি তাণ্ডব চলেছে, বহু মানুষের ওপর রাষ্ট্রীয় অত্যাচার নেমে এসেছে, রক্তপাত হয়েছে, প্রাণহানিও। একটি দৃষ্টান্ত দিলেই চলবে। উগ্রপন্থা দমনের নামে ২০১৪ সালে শিনজিয়াংয়ের একটি খেলার স্টেডিয়ামে বহু দর্শকের সামনে ৫৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড চুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চিনা সরকার স্থানীয় মানুষকে দেখিয়েছিল, উগ্রপন্থাকে কেমন কড়া ভাবে দমন করতে পারে তারা।

কিন্তু এই সরাসরি দমন করার পন্থা যথেষ্ট নয়, সেটা তারা ক্রমে ক্রমে বুঝেছে। অনেক দশক ধরে কঠোরতম শাসন চালিয়েও উইগুরদের স্বাতন্ত্র্যের আকাঙ্ক্ষাকে শেষ করে দেওয়া যায়নি, বার বার তাঁরা বিদ্রোহ করেছেন, স্বশাসিত এলাকা নামটার মর্যাদা দাবি করেছেন। আর তাই, গুলিবারুদ এবং মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি বেজিংয়ের শাসকরা অন্য উপায়ও ভেবেছেন। এমনিতেই বহু দশক ধরে উইগুরদের নিজভূমে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার উদ্দেশ্যে হান-চিনাদের বসতি বাড়ানো হয়েছে। ১৯৪৯ সালে শিনজিয়াংয়ের চার ভাগের তিন ভাগ মানুষ ছিলেন উইগুর, এখন তাঁদের অনুপাত অর্ধেকের নীচে নেমে এসেছে। কিন্তু তাতেও এখন আর শানাচ্ছে না। সামগ্রিক ভাবে উইগুর সত্তাকেই মুছে দিতে চাইছে পার্টি। তাদের নীতি হল— ওদের লট কে লট কব্জা করো, আপাদমস্তক ভোল পাল্টে দাও, যাতে তাদের নিজস্ব পরিচিতিটাই মুছে যায়। সেটাই তো বশ্যতার চরম অবস্থা।

কিন্তু কাল থেকে যদি কারও নাম জোর করে বদলে দেওয়া হয়, তার কেমন লাগে? রাতারাতি অস্তিত্ব বদল? তা-ও জোর করে? চিনা সরকার শিনজিয়াংয়ে একটি নামের তালিকা প্রকাশ করেছে। ছেলেমেয়েদের সেই সব নাম রাখা চলবে না। ষোলো বছরের নীচে যে কোনও ছেলেমেয়ের নামই বদল করে চিনা নাম রাখতে হবে। তা না হলে, স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সমস্যা, চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা। কেবল তা-ই নয়, উইগুরদের পদ্ধতিতে লেখাপড়া, তাঁদের ভাষায় লেখাপড়ার চল কমিয়ে দিচ্ছে সরকার। উইগুর-স্নাতক চাকরি পায় না, পেলেও মাইনে হান-চিনাদের তুলনায় নামমাত্র। যাতে উইগুররা পেটের দায়ে, জীবনের তাগিদে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য মুছে দিতে বাধ্য হন।

নাম বদলানো তো প্রথম পদক্ষেপ। তার পর আছে ‘ওয়ান রিলেটিভ পলিসি’, অর্থাৎ কিনা আত্মীয় দত্তক নেওয়ার আদেশ। ধরা যাক, হঠাৎ এক দিন সব দিক থেকে সম্পূর্ণ অন্য রকম এক মানুষকে দেখিয়ে বলা হল, ইনি তোমার কাকা। মানে ইনিই যেন তোমার আজীবন কাকা ছিলেন। তুমি ওঁকে এ বার থেকে কাকা-জ্ঞান করবে, ভালবাসবে। ব্যাপারটা সে রকমই। মানে মনে মনে তোমায় মানতে হবে, তুমি ও তোমার পূর্বপুরুষ আসলে এ ভাবেই বেঁচে ছিলে! এমন নীতি মানা কি সহজ? বিশেষ করে খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে? যে খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে অনেক সময়েই ধর্মাচরণের গভীর সংযোগ? অনেক উইগুর মানুষ, বিশেষ করে বয়স্করা বলছেন, ‘‘ওরা শুয়োর খায়, আমাদের ধর্মে তো শুয়োর খাওয়া নিষেধ।’’ আবার দায়ে পড়ে অনেকে, বিশেষ করে কমবয়েসিরা বলছে, ‘‘কী আর এমন হয়েছে? ভালই তো আছি।’’ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে দত্তক নিতে নিতে এক সময় হয়তো সত্যিই উইগুররা হান-চিনা হয়ে যাবেন।

এখানেই শেষ নয়। উইগুর ছেলে-বুড়ো-মহিলা-বৃদ্ধা সবাইকে চিনা জীবনধারা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে শিক্ষিত করে তুলতে তৈরি হয়েছে ‘রি-এডুকেশন ক্যাম্প’। বাধ্যতামূলক নবশিক্ষা। শিক্ষার্থীরা পালিয়ে যাবে, তার উপায় নেই। কাঁটাতারে বিদ্যুৎ সংযোগ করা আছে। অন্য রকম শিক্ষার ব্যবস্থাও আছে— যে সব বৃদ্ধ মা-বাবার ছেলেপুলে বিদেশে রয়েছেন, তাঁদের বেদম শিক্ষা দিয়ে বলা হচ্ছে, ছেলেমেয়েদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাততাড়ি গুটিয়ে দেশে ফিরতে বলো। আনুমানিক দশ লক্ষ, কোনও কোনও হিসেবে কুড়ি লক্ষ উইগুরকে এই রকম ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়েছে। নাৎসি ক্যাম্পের পর এত বড় মাপের বন্দি-আখড়া আর বোধ হয় পৃথিবীর কোথাও হয়নি। এই নিয়ে সরব হয়েছে আমেরিকা-সহ অন্যান্য দেশে থাকা উইগুর মানুষজন, রাষ্ট্রপুঞ্জ কড়া রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, নানা বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়েছে দুনিয়ার নানা জায়গায়, যেমন সম্প্রতি হয়ে গেল প্যারিসে। কিন্তু লাভ হয়নি। চিনের মন্ত্রী বা অন্য কর্তাদের প্রশ্ন করা হলে তাঁরা ঠান্ডা গলায় স্থির দৃষ্টিতে উত্তর দিয়েছেন, এ রকম কিছু কোথাও হয়েছে বলে তাঁদের জানা নেই। কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ স্থানাধিকারী নেতা ওয়াং ইয়ং সদ্য উইগুরদের রাজ্যে সফর সেরে বেজিংয়ে ফিরে এসে বিবৃতি দিয়েছেন, ‘‘শিনজিয়াং-এর উন্নতি বেশ ভাল ভাবেই হচ্ছে।’’ অর্থাৎ, অনুমান করা যায়, উইগুরদের বেশ বাগে আনা গিয়েছে।

শুধু কি রি-এডুকেশন ক্যাম্প? উইগুরদের ‘নিরাপত্তা’র নামে বসতি এলাকাতেও কিছু দূর অন্তর অন্তর নজরদারির ক্যাম্প করা হয়েছে। এমনও জায়গা আছে যেখানে পাঁচশো মিটার অন্তর এমন শিবির। নিদেনপক্ষে ডজনখানেক পুলিশ সর্ব ক্ষণ নজরদারি চালায় আশেপাশের এলাকার ওপর। প্রত্যেকটি থানা উচ্চমানের প্রযুক্তি সাহায্যে যোগাযোগ রাখে একে অপরের সঙ্গে। কোনও এলাকায় সামান্যতম ট্যাঁফো হলেও অন্য থানার নজরদাররা ফোর্স নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অতএব উইগুরদের এক চুল বেচাল হওয়ারও উপায় নেই।

নজরদারি কেবল পুলিশের কাজ নয়। প্রত্যেককে বলে দেওয়া হয়েছে অন্য প্রতিবেশীদের ওপর নজর রাখতে হবে। কারও বাড়িতে আত্মীয়স্বজন বেশি সময় কাটালে, পড়শি তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন, কেন এসেছেন, কী কী কথা হল, এত ক্ষণ রয়েছেন কেন, এখান থেকে আপনি কোথায় যাবেন, এই সব। এবং কারও ওপর সন্দেহ হলেই রিপোর্ট করতে হবে স্থানীয় পুলিশে। তবেই না সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে!

তা হলে? কোন পথে যাবে উইগুর? সে জান রাখবে না মান রাখবে? চিন, হান রঞ্জক-সাবানে ডুবিয়ে যে উইগুরকে চিনা করে ফেলতে চাইছে, সে খান থাকবে না হান হবে? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ। আপাতত কেবল এটুকুই দেখার আর ভাবার যে, সংখ্যাগুরুর দাপট কোথায় পৌঁছতে পারে। এমন দাপট যে সংখ্যালঘুর নিজস্ব খাওয়া, পরা, ধর্ম, আচরণ, জীবনযাত্রা এমনকি নামখানা পর্যন্ত লোপাট হয়ে যেতে পারে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Uighurs Human Rights Xinjiang
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE