Advertisement
২১ মে ২০২৪

তোষণ বনাম উন্নয়ন?

ভারতে যাঁরা ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন, সেই মুসলিমদের নিছক একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বদলে একটি আর্থ-সামাজিক শ্রেণি হিসেবে দেখার চেষ্টা হয়নি।

সীমান্ত গুহঠাকুরতা
শেষ আপডেট: ৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০৪
Share: Save:

গত কিছু দিন যাবৎ রাজ্য-রাজনীতিতে অভিযোগ এবং পালটা অভিযোগের তরজা জমে উঠেছে একটি শব্দকে ঘিরে। সেটি হল ‘তোষণ’। ঘটনা এই যে, চৌত্রিশ বছরের কমিউনিস্ট শাসনও এ রাজ্যে সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কোনও পরিসর তৈরি করতে পারেনি। তাই হয়তো বামপন্থাকে পিছনে ফেলে একটি আদ্যন্ত সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন রাজনৈতিক দল সম্প্রতি প্রধান বিরোধী শক্তি হিসেবে উঠে আসার লক্ষণ দেখাতে পারছে। এবং সেই দলের নেতানেত্রীরা বর্তমান শাসক দলের বিরুদ্ধে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’-এর অভিযোগ তুলে হাওয়া গরম রাখতে সদাই তৎপর। সেই যূথবদ্ধ আক্রমণের মুখে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটির দিশেহারা দশাও ক্রমশই প্রকট হচ্ছে। তাই তাদেরও রাজনীতির প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ধর্ম। কখনও মহরম বনাম বিজয়া দশমী বিতর্কে সরগরম হচ্ছে সোশ্যাল-মিডিয়া, কখনও ‘বিবেকানন্দ কার’, সেই বিবাদে রক্তাক্ত হচ্ছে খাস কলকাতার রাজপথ। কে বেশি হিন্দু আর কে অধিক মুসলিমদরদি, এই ‘তুই বেড়াল না মুই বেড়াল’ মার্কা প্রতিযোগিতাই এ-রাজ্যের রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠেছে।

অভিধান বলছে, ‘তোষণ’ শব্দটির অর্থ ‘সন্তুষ্টি বিধান করা’ বা ‘তুষ্ট করা’। রাজনৈতিক বিচারে তাই সেটাই তোষণ, যা কোনও বিশেষ গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধা পাইয়ে দেওয়ার পথে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করে। এখানে ‘তাৎক্ষণিক’ শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ। ভেবে দেখলে, ‘উন্নয়ন’ শব্দটি ‘তোষণ’-এর বিপরীত না হলেও তাদের সম্পর্কটি কিন্তু সচরাচর ব্যস্তানুপাতিকই হয়ে থাকে। উন্নয়ন ব্যাপারটাই দীর্ঘমেয়াদি। প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত কোনও কর্মসূচি সচরাচর মানুষকে তাৎক্ষণিক ভাবে সন্তুষ্ট করতে পারে না। কারণ, তা যথেষ্ট সময় এবং শ্রম-সাপেক্ষ। এই দুইয়ের আর একটি মৌলিক পার্থক্য হল, যথার্থ উন্নয়নের কোনও ‘আমরা-ওরা’ হয় না। বিশেষত, প্রকৃত গণতন্ত্রে তা সকলের জন্য সমানুপাতে প্রযোজ্য হবে, এটাই প্রত্যাশিত। প্রকারান্তরে তোষণ সব সময়ই স্বল্পমেয়াদি লক্ষ্যপূরণে এবং গোষ্ঠীগত ক্ষুদ্র-স্বার্থে প্রযুক্ত হয়।

মুশকিল হল, ভারতে যাঁরা ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকেন, সেই মুসলিমদের নিছক একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বদলে একটি আর্থ-সামাজিক শ্রেণি হিসেবে দেখার চেষ্টা হয়নি। রাজনীতির এই ‘গোড়ার গলদ’ই আজ বিষবৃক্ষে পরিণত। মুসলিমরা বরাবরই যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে নিছক ‘ভোটব্যাংক’ হয়ে থেকে গেছে। এবং মুসলিমদের জন্য কিছু করাকে এ দেশের সব শাসকই ‘দয়া’ হিসেবে দেখেন। মুসলিম সমাজের উন্নয়নের সঙ্গে যে দেশের সার্বিক উন্নতির প্রশ্নটিও জড়িয়ে আছে, সেই বোধটিই এ দেশের রাজনীতিতে তেমন ভাবে কোনও দিন জেগে ওঠেনি। আজ তাই নতুন ভাবে ভাবা দরকার।

সাড়ে তিন দশকের বাম-শাসন এ রাজ্যের মুসলিম জনসমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে যে প্রায় কিছুই করেনি, ২০০৬ সালে প্রকাশিত রাজিন্দর সাচার কমিটির রিপোর্টেই তা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সরকারি বা বেসরকারি চাকরি, সর্বত্রই মুসলিমদের প্রতি তৎকালীন শাসকের বঞ্চনা যে সীমাহীন, দারিদ্রের প্রশ্নে তাঁরা যে এ রাজ্যে ভয়াবহ রকমের নীচে অবস্থান করেন, তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তা প্রমাণ করে দিয়েছিল ওই রিপোর্ট। সাচার রিপোর্টের প্রতিক্রিয়ায় বাম সরকারের সেই তথাকথিত মুসলিম ভোটব্যাংকে ধস নামে, পরে সে ভোট প্রায় পুরোটাই গিয়ে জমা হয় তৃণমূল কংগ্রেসের তহবিলে। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, নিরাপদে নিজের ধর্মাচরণের অধিকারটুকু পেলেই এ রাজ্যের মুসলিম সমাজ সন্তুষ্ট থাকতে রাজি নয়, তাদের কিছু সুনির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দাবিও আছে, যেগুলোর কথা আমরা সচরাচর ভুলে থাকতে বা উপেক্ষা করতেই অভ্যস্ত।

তৃণমূল কংগ্রেস সরকারেরও তো সাত বছর অতিক্রান্ত হতে চলল। ‘তোষণ’, না কি ‘উন্নয়ন’— সংখ্যালঘুদের জন্য আসলে কোন ‘পলিসি’ নিয়ে চলছে এই সরকার, তা এ বার বিচার করে দেখার সময় এসেছে। প্রাথমিক ভাবে বলা যায়, সেই বিচার থেকে একটা মিশ্র ছবি উঠে আসে। যেমন, আমাদের রাজ্যের যে জেলাটিতে সর্বাধিক সংখ্যক মুসলিম মানুষের বসবাস, সেই মুর্শিদাবাদে বাল্যবিবাহ রুখতে প্রশাসনের সক্রিয় সহযোগিতায় ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’দের সাফল্য সত্যি সত্যিই আশা জাগায়। আবার যখন জানতে পারি যে, গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আবাসন শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় রাজমিস্ত্রির জোগান দিয়ে চলেছে সেই মুর্শিদাবাদই, যাদের একটা বিরাট অংশই আবার স্কুল-ছুট কিশোর বা সদ্য-যুবক, তখন উন্নয়নের ডঙ্কা-বাদন আর তার আড়ালে থাকা রূঢ় বাস্তবটা নিয়ে ধন্দে পড়ে যেতে হয় বইকি!

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Proitiation Development TMC Government
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE