Advertisement
E-Paper

আশ্বস্ত হওয়া গেল না

সবচেয়ে গুরুতর সুপারিশ স্কুলশিক্ষা নিয়ে। এই সুপারিশ গৃহীত হলে ভারতে স্কুলশিক্ষার ছক পাল্টে যাবে।

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০১৯ ০০:০৪

জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়া সুপারিশের রিপোর্টখানা ভয়ে ভয়ে খুলেছিলাম। আয়তন প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠা, কিন্তু ভয়ের কারণ অন্য। গত পাঁচ বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষা পরিচালনার খতিয়ান গৌরবময় নয়। সেই সরকারের নিযুক্ত কমিটির সুপারিশ নিয়ে দ্বিধা থাকতেই পারে।

প্রথম প্রতিক্রিয়া হল স্বস্তির। রিপোর্টটি সুবিন্যস্ত ও সুলিখিত। তাতে সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ছাপ আছে, আছে অপ্রিয় সত্যের স্বীকার এবং কিছু মূল্যবান প্রস্তাব। বলতেই হয় এটি সিরিয়াস প্রচেষ্টা, আপন বক্তব্যের খাতিরেই আলোচনা দাবি করে, কেবল প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক কারণে নয়।

সবচেয়ে গুরুতর সুপারিশ স্কুলশিক্ষা নিয়ে। এই সুপারিশ গৃহীত হলে ভারতে স্কুলশিক্ষার ছক পাল্টে যাবে। প্রাক্‌প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, স্কুলশিক্ষার বর্তমান বিস্তার তেরো বছর, পাঁচ থেকে আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত; ভাগটা ১+৫+৩+২+২। নতুন প্রস্তাবে প্রাক্‌প্রাথমিকে আর দুই বছর জুড়ে মেয়াদ হবে পনেরো বছর, বয়স তিন থেকে আঠারো, ভাগ ৫+৩+৩+৪। প্রাক্‌প্রাথমিকের সঙ্গে যুক্ত হবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি, প্রারম্ভিক (ফাউন্ডেশনাল) পর্যায়ে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিও হবে একটা ধাপ, মাধ্যমিক স্তরে কোনও যতি থাকবে না।

তিন থেকে পাঁচ বছরের দরিদ্র শিশুরা এখন যায় সংহত শিশুবিকাশ বা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে, সম্পন্ন ঘরের শিশুরা কিন্ডারগার্টেনে। অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থা এ বার প্রাথমিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হবে। পুষ্টি, স্বাস্থ্য ইত্যাদির ব্যবস্থা পূর্ববৎ চলবে কিন্তু শেখার পাট বাড়বে। কেন্দ্রগুলি হবে মুখ্যত শিক্ষায়তন, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা সেখানেই কাটাবে।

উদ্দেশ্য সাধু। কমিটি ঠিকই বলেছে, গরিব ও শিক্ষাবঞ্চিত পরিবারের শিশুরা স্কুলজীবনের প্রথম ক’মাসেই পিছিয়ে পড়তে শুরু করে, আর সেই ব্যবধান কোনও দিন ঘোচে না। সুতরাং শিক্ষায় সাম্য আনার এটাই হয়তো একমাত্র উপায়। শিক্ষাদানের প্রস্তাবিত রীতিও মনোগ্রাহী ও আলোকপ্রাপ্ত। বলা হচ্ছে, এই স্তরে (পরবর্তী কালেও) ঝোঁক থাকবে তথ্য শেখানোয় নয়, চিন্তা-উপলব্ধি-অনুসন্ধান-সমাধানের মৌলিক মননক্রিয়াগুলি ফুটিয়ে তোলায়। কিন্তু সময় ও দরদ দিয়ে, প্রত্যেক শিশুর আলাদা চাহিদা অনুসারে বিকাশ ঘটাতে যত শিক্ষক ও পরিকাঠামো চাই, তা জোগাবার হদিশ রিপোর্টে নেই। না জোগালে কিন্তু আনন্দময় বিদ্যার জগতে মুক্তিলাভের বদলে বাচ্চাগুলি আরও কচি বয়সে আটকে যাবে ভীতিপ্রদ যান্ত্রিক তালিমের জাঁতাকলে; সৌভাগ্যবান শিশুদের সঙ্গে ব্যবধান কমবে না, বাড়বে।

‘উদারমনস্কতা’ বড়ই ফিকে

এখানেই আসল প্রশ্ন। প্রাথমিক শিক্ষায় দেশ জুড়ে বিপুল ঘাটতি, কমিটি তা বিলক্ষণ মানছে। কিন্তু তা মেটাতে অর্থ, লোকবল, শিক্ষণপদ্ধতি ও প্রশাসনে যে সমুদ্রলঙ্ঘন করতে হবে, তা যেন সদস্যেরা বুঝেও বোঝেননি; একেবারেই বোঝেননি অঙ্গনওয়াড়ির ক্ষেত্রে সমুদ্রটা কত অপার। সরকারি প্রবঞ্চনায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা খাতাকলমে স্বেচ্ছাসেবী; কেন্দ্রগুলিতে খাদ্য ও অর্থের জোগান চরম অপ্রতুল ও অনিয়মিত। রিপোর্টে এই পাহাড়প্রমাণ সমস্যার উল্লেখ বড় মৃদু ও সংক্ষিপ্ত। রিপোর্ট জুড়েই মনে হয়, প্রণেতাদের সদিচ্ছা ও উদ্ভাবনশক্তির অভাব নেই; তাঁরা সমস্যা মানতে রাজি, সমাধানও বাতলাচ্ছেন, কিন্তু রূপায়ণের আলোচনা হাওয়ায় ভাসছে। অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত শিক্ষক নিয়োগ ও প্রশিক্ষণে, একমাত্র পন্থা— বিপুল জরুরি কর্মকাণ্ড বা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম। সেই তাগিদের সুরটি রিপোর্টে অনুপস্থিত।

লোকবল না জুটলে কমিটির অধিকাংশ প্রস্তাব মুখ থুবড়ে পড়বে। স্কুলে ও স্কুলের বাইরে শিক্ষকদের নানা নতুন দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে (যদিও, হ্যাঁ, স্পষ্ট বলা হচ্ছে তাঁদের অন্য সরকারি কাজে ডাকা যাবে না, নির্বাচনের কাজে বা স্কুলের নিজস্ব প্রশাসনিক কাজেও নয়)। শিক্ষা-অধিকার আইন মোতাবেক প্রাথমিক স্তরে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ৩০:১ রাখলে এত দায়িত্ব সামলানো অসম্ভব। শিক্ষকদের বেতন নিয়ে কিছু আলোচনা আছে, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ক্ষেত্রে আদৌ নেই। প্যারাটিচার পদের লোপ ঘটিয়ে সব শিক্ষকের এক বেতনক্রমের অপরিহার্য সুপারিশ আছে। কিন্তু ভারত জুড়ে শিক্ষকদের বেতনে কত রকমফের, ন্যূনতর থেকে ন্যূনতমে নামানোর কত ফন্দি, তার সম্যক উপলব্ধি নেই। নতুন এক শ্রেণির শিক্ষাসহায়কের প্রস্তাব হচ্ছে, যাঁরা মাইনে পাবেন (তেমনই ইঙ্গিত) যৎসামান্য; আর থাকবেন অবৈতনিক স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী, ছাত্রেরাও (এমনকি প্রাথমিক স্তরে!) পরস্পরকে তালিম দেবে। অতীতে জাতীয় সাক্ষরতা মিশন চালু হয়েছিল পুরোপুরি স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। প্রকল্পটির খণ্ডিত সাফল্যের জন্য বহুলাংশে দায়ী এই কার্পণ্য।

শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে আরও অনেক বক্তব্য আছে, নজিরবিহীন ভাবে একটা গোটা পরিচ্ছেদ জুড়ে। শিক্ষকশিক্ষণের আলোচনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাতে জোর সওয়াল, এই প্রশিক্ষণকে বেসরকারি ব্যূহ থেকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল আওতায় নিয়ে আসার। সাধারণ প্রাক্‌স্নাতক পাঠ্যক্রমের সঙ্গে বিএড জুড়ে চার বছরের ইন্টেগ্রেটেড কোর্সের প্রস্তাবটি বিশেষ ভাবে বিবেচনার যোগ্য। সব মিলিয়ে শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষকের মৌলিক গুরুত্ব প্রত্যয়ের সঙ্গে স্বীকৃত হয়েছে, সেটা কম প্রাপ্তি নয়। আশঙ্কা একটাই: বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটবে তো?

আরও অভিনব প্রাপ্তি, শিক্ষায় সাম্য ও সমানাধিকার নিয়ে একটি পরিচ্ছেদ। তাতে সমাজের প্রত্যেকটি বিভাজক শক্তি নিয়ে আলোচনা আছে, আছে সমাধানের ইঙ্গিত। জাতি, উপজাতি, ধর্ম, অঞ্চল, প্রধান ও গৌণ ভাষাগোষ্ঠী, দারিদ্রজনিত ও লিঙ্গজনিত বঞ্চনা, কোনওটাই বাদ যায়নি, যায়নি বাস্তব বাধার পাশাপাশি মানসিক ভেদাভেদের আলোচনা। শিক্ষাব্যবস্থা সরাসরি এই বিভেদগুলি কতটা দূর করতে পারে বলা শক্ত; তবে শিক্ষা পরিষেবা যত সমবণ্টিত হবে, সর্বোপরি শিক্ষকদের আচারে-মানসিকতায় (নীতিশিক্ষা বা ‘মূল্যবোধ শিক্ষা’য় নয়) সমদর্শিতা যত ফুটে উঠবে, বিভেদের প্রকোপ তত কমবে, এ আশা রাখতেই হয়। ফের একই প্রশ্ন: সুপারিশ রূপায়ণ করবেন যে শাসক সম্প্রদায়, তাঁরা প্রাণ থাকতে এমন হতে দেবেন কি?

আর একটি মূল্যবান প্রস্তাব বরং বিতর্কহীন: অনেকগুলি স্কুল নিয়ে একটা ক্লাস্টার বা গুচ্ছ গঠন করা। তাতে নানা উপকার হতে পারে— একাধিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভাগ হলে দামি সরঞ্জাম ও পরিকাঠামোর খরচ পড়তায় পোষাবে ও পূর্ণ সদ্ব্যবহার হবে; এক স্কুলে শিক্ষকের সাময়িক ঘাটতি অন্য স্কুল থেকে মেটানো যাবে (এ ব্যবস্থার অপব্যবহারও অবশ্যই সম্ভব); কোনও উপকারী উদ্ভাবন সহজেই স্কুল থেকে স্কুলে ছড়িয়ে যাবে; এক কথায়, গোটা অঞ্চল জুড়ে শিক্ষা সম্বন্ধে সহমত ও সহযোগিতার একটা আবহ গড়ে উঠবে।

অন্য খাতে কিন্তু গুরুতর চিন্তা থেকে যাচ্ছে, যেমন পাঠ্যক্রম নিয়ে। রিপোর্ট প্রকাশমাত্র তরজা শুরু হল হিন্দি শিক্ষার সুপারিশ নিয়ে, চটজলদি উপশমও হল। রিপোর্টের ওই অংশের আদি ও সংশোধিত বয়ান মেলালে একটা অস্পষ্টতা ধরা পড়বে। তার আড়ালে আছে ভাষাশিক্ষা নিয়ে ব্যাপক ভাবে উদ্বেগজনক কিছু ইঙ্গিত।

দেশের সব ছেলেমেয়েকে তিনটি ভাষা শিখতে হবে (যদিও হিন্দি বলয়ে কখনওই হবে না ধরে নেওয়া যায়)। তালিম শুরু হবে প্রাথমিক, এমনকি প্রাক্‌প্রাথমিক স্তরে! এই শেষ প্রস্তাবের দোহাইয়ে কগনিটিভ সায়েন্সের তত্ত্ব পাড়া হলেও এমন বিধানে পিলে চমকায়। এত শিক্ষক জুটবে কোথায়, তারও হদিশ নেই। উপরন্তু পরের পর্যায়ে আবশ্যিক ভাবে পড়তে হবে একটি প্রাচীন ভাষা। বলতেই হয়, কেবল ভাষা শিখে ছেলেমেয়েরা স্কুলজীবনের কত অংশ ব্যয় করবে? ভাষাশিক্ষার ভূত চিরকাল পাঠ্যক্রমে জেঁকে আছে, শিক্ষানীতি ছাপিয়ে রাজনীতির দাবিতে; এ বারও তার ব্যতিক্রম ঘটল না।

দ্বিধা ঘনীভূত হয় ইংরেজির গুরুত্ব হ্রাসের রোখ দেখে। মানতেই হবে, আমাদের সমাজে ইংরেজি হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈষম্য ও বঞ্চনা কায়েম করার হাতিয়ার। এর প্রতিকারের জন্য সব শিক্ষার্থীর পর্যাপ্ত ইংরেজিপাঠই কি যুক্তিযুক্ত নয়? তার বদলে বিস্ময়কর ভাবে বলা হচ্ছে, ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে ব্যর্থ, সব উন্নত দেশে নাকি নিজস্ব ভাষায় বিদ্যাচর্চার প্রবণতা বাড়ছে। আমরা সকলেই মানব যে ভারতে বিদ্যাক্ষেত্রে (বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও) নিজস্ব ভাষার ব্যবহার বাড়ানো উচিত, উচিত ভাষাগুলিকে আরও সমৃদ্ধ করা ও তাদের মধ্যে আদানপ্রদান সুনিশ্চিত করা। সেই উদ্দেশ্যে একটি ‘জাতীয় অনুবাদ সংস্থা’র প্রস্তাবও ভাল। কিন্তু আমাদের কৃষ্টির সম্পদ যে বহুভাষিকতা (রিপোর্টে তার দরাজ স্বীকৃতি আছে), তার মধ্যে ইংরেজিকে কোণঠাসা করার উদ্যোগ স্ববিরোধী ও আত্মঘাতী। প্রচেষ্টা সফল হলে বিশ্ববিদ্যায় ভারতের অধিকার সঙ্কুচিত হতে বাধ্য; আর রিপোর্টে বলুক না বলুক, কায়েম হতে বাধ্য হিন্দির আধিপত্য।

শুধু ভাষা নয়, প্রবল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতি ও প্রাচীন বিদ্যার পুনঃপ্রতিষ্ঠায়। এটাও নিশ্চয় সাধু প্রস্তাব, কিন্তু অনেক খটকা থেকে যায়। ছাত্রেরা এ বার গুণতে শিখবে খর্ব-নিখর্ব-পদ্ম-শঙ্খের হিসাবে। প্রাথমিক শিক্ষণ হবে ‘টাইম-টেস্টেড ইন্ডিয়ান ট্র্যাডিশন’ অনুসারে। সেটা ঠিক কেমনধারা? সে কালের গুরুমশাইয়ের পাচনের বাড়ি নয় তো? ব্যাখ্যা থাকলে আশ্বস্ত হওয়া যেত। এ দিকে বৃহত্তর দুনিয়ার চিন্তা, জ্ঞান ও জীবনধারার লেশমাত্র স্বীকৃতি নেই। রিপোর্টের খোলামেলা বাচনভঙ্গি ও আপাত উদারমনস্কতা তাই শেষ অবধি বড় ফিকে লাগে।

সবচেয়ে আশ্চর্য, বিজ্ঞানশিক্ষা নিয়ে অবিশ্বাস্য নীরবতা। প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চার প্রচুর উল্লেখ আছে; শব্দ খরচ হয়েছে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা, কলাশিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার, এমনকি বিজ্ঞানের ধাঁধা নিয়ে। কিন্তু গণিতের উল্লেখ কেবল শিশুদের মৌলিক সংখ্যাবোধ প্রসঙ্গে। কম্পিউটার শিক্ষার আলোচনা একটিমাত্র অনুচ্ছেদে। যথার্থ বিজ্ঞানশিক্ষা বলতে আমরা যা বুঝি, স্কুল নিয়ে দেড়শো পাতায় সে সম্বন্ধে সরাসরি একটা বাক্য নেই। কম্পিউটার সার্চ করে দেখলাম, এই অংশে ‘সায়েন্স’ শব্দের প্রতিটি উল্লেখ লঘু বা তাৎক্ষণিক প্রসঙ্গে; বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার নামোল্লেখ (ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি ইত্যাদি) এক বার করে, তাও কথাচ্ছলে।

যা নেই, তা নিয়ে বিতণ্ডা চলে না; কিন্তু অভাবটা তুলে ধরা চলে, চলে তা নিয়ে আক্ষেপ ও বিস্ময়প্রকাশ। শেষ অবধি উঠে আসে ভারী বেয়াড়া, ভারী মর্মান্তিক প্রশ্ন: এই প্রস্তাব কার্যকর হলে ভারতে স্থাপিত হবে কোন বিদ্যাবিধি বা নলেজ অর্ডার?

‘অতিমানবিক’ বিদ্যা

জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়ায় উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত কয়েকটি নীতির উল্লেখ আছে, যা প্রত্যেক শিক্ষায়তনে ও শিক্ষা দফতরে টাঙিয়ে রাখা উচিত। এক, উচ্চশিক্ষায় ব্যক্তিবিশেষের উন্নতি হতে পারে, কিন্তু উচ্চশিক্ষা মুখ্যত ব্যক্তির নয়, সমাজের সম্পদ। দুই, অতএব উচ্চশিক্ষার মূল আর্থিক দায় সরকারকে বহন করতে হবে। তিন, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য চাই ‘যথার্থ ও পূর্ণ স্বাধীনতা— সারস্বত, আর্থিক, প্রশাসনিক’। একটি অধ্যায়ের শিরোনামই হল ‘উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে শিক্ষকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা’।

কথাগুলো নতুন নয়, তবে দুর্দিনে তার এত স্পষ্ট উচ্চারণ অপ্রত্যাশিত ছিল। আরও অপ্রত্যাশিত সারস্বত স্তরে মৌলিক দিকবদলের প্রস্তাব, স্কুলশিক্ষাতেও যা দেখা গিয়েছিল। উচ্চশিক্ষার মূলমন্ত্র হিসাবে পেশ হচ্ছে ‘লিবারেল আর্টস’ নামক বিদ্যাপ্রণালী। ‘লিবারেল এজুকেশন’ নামটাও আছে, কিন্তু ঝোঁক বিলক্ষণ কলা ও মানবিকবিদ্যার দিকে, খাতাকলমে যদিও বলা হচ্ছে বিজ্ঞান ও মানবিক উপাদান একত্র করে বিদ্যার যথার্থ প্রসার ঘটানো হবে। বিষয়ে-বিষয়ে কৃত্রিম বাঁধ ভেঙে লেখাপড়া হবে সত্যি সত্যি আন্তর্বিষয়ক, ইন্টারডিসিপ্লিনারি।

এতে বিদ্যাচর্চায় বিপ্লব আসবে, কিন্তু একটু ব্যাখ্যা পেলে ভাল হত। ভারতের কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘লিবারেল আর্টস’ বা ‘লিবারেল স্টাডিজ়’এর পাঠ্যক্রম চালু আছে। তার উপাদান মানবিক ও সমাজবিদ্যার নানা শাখা, হয়তো সঙ্গে গণিত; বিষয়গুলি সচরাচর পড়ানো হয় আলাদা ভাবে, যুক্ত হয় (যদি হয়) সমগ্র পাঠ্যক্রমের প্রেক্ষিতে। সম্প্রতি বিরল ক্ষেত্রে পাশাপাশি বিজ্ঞানশিক্ষা শুরু হয়েছে। তাতে সমন্বয়টা বহু গুণ উদ্দীপক হবে; কতটা সফল হবে, ভবিষ্যৎ বলবে।

এমন পাঠ্যক্রমের আদি মডেল মার্কিন প্রাক্‌স্নাতক ব্যবস্থা, যেখানে ছাত্ররা নানা বিষয়ের কোর্স থেকে ইচ্ছামতো বাছতে পারে, একটিকে গুরুত্ব দিতে পারে ‘মেজর’ হিসাবে। এ দেশে সদ্য চালু সিবিসিএস-এর মোটামুটি এক উদ্দেশ্য। ‘লিবারেল আর্টস’-এর তত্ত্বে ধারণাটা আরও নিবিড়, আরও প্রসারিত হচ্ছে। সত্যিই এখানে একটা তত্ত্ব বা দর্শন কাজ করছে; বাস্তব পাঠ্যক্রমে তা কী ভাবে রূপায়িত হবে, তা নিয়ে কিন্তু ধন্দ রয়ে যাচ্ছে, যেমন ছিল স্কুলশিক্ষার নানা বিষয়ে। অথচ ধারণাটা এতই নতুন, বিশদ নির্দেশ না পেলে শিক্ষকরা আতান্তরে পড়বেন, প্রস্তাবটা মাঠে মারা যাবে।

এক জায়গায় বলা হচ্ছে, প্রাক্‌স্নাতক ছাত্রেরা শিখবে কিছু মূল বৌদ্ধিক ক্রিয়া ও পদ্ধতি— বিশ্লেষক চিন্তা (ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং), ভাবপ্রকাশে দক্ষতা, নান্দনিক চেতনা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সামাজিক ও নৈতিক চেতনা; সঙ্গে ভারতের ইতিহাস, সমাজ ও সংবিধান। উপরন্তু একটি নির্দিষ্ট বিষয় থাকবে ‘মেজর’ হিসাবে, ‘মাইনর’ আর একটি। এই শেষটুকু গতানুগতিক, যদিও কর্মসংস্থানে অপরিহার্য। আগের অংশটা অভিনব, নীতি হিসাবে অবশ্যই স্বাগত, কিন্তু সেটা কী রূপ নেবে? উক্ত নীতি-রীতি-অভ্যাসগুলি কি স্বতন্ত্র, বিষয়বিচ্ছিন্ন ভাবে পড়ানো হবে? যদি হয়, তার পাঠ্যক্রম কেমন হবে, পড়াবেনই বা কারা? না কি পড়তে হবে কলা ও বিজ্ঞানের কিছু প্রচলিত বিষয়, তার মাধ্যমেই নীতি-রীতির অনুশীলন হবে? আরও নানা উপাদান, মায় বৃত্তিবিদ্যা (ভোকেশনাল স্টাডিজ়) ও খেলাধুলো সবই লিবারেল আর্টসের ছত্রচ্ছায়ায় জড় হচ্ছে। কৌতূহল হয়, সবগুলি কোন স্তরে ও পদ্ধতিতে, কতটা অঙ্গাঙ্গি হবে? না কি মামুলি সিবিসিএস-এর মতো, এক পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তিই হবে একমাত্র যোগসূত্র?

(চলবে)

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।

Education National Policy on Education Narendra Modi BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy