সকালে মশারি ছাড়িয়াই ফুলহাতা জামা এবং ফুলপ্যান্ট পরিয়া লও, বেলা বারোটার পূর্বে বাহিরে যাইয়ো না, নচেৎ ডেঙ্গি আসিবে— ইহাই এখন সন্তানদের প্রতি বাংলার জননীদের নিরন্তর সম্ভাষণ। শহরে ও গ্রামে ডেঙ্গি তাহার জাল এমনই বিছাইয়াছে, যে বর্গিরাও লজ্জা পাইবে। গত বৎসর শ্রীরামপুরে ডেঙ্গি এমন মারাত্মক রূপে ছড়াইয়াছিল যে স্বাস্থ্য দফতর সমস্ত তথ্য প্রকাশ করিয়া ওই অঞ্চলে ডেঙ্গিকে মহামারি ঘোষণা করিতে বাধ্য হইয়াছিল। কিন্তু দিন বদলাইয়াছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়া যাইলে মানুষ ঘুরিয়া দাঁড়াইবার মরিয়া চেষ্টা করে। যেমন ১৯৯১ সালের আর্থিক সংকটের তাড়নায় অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ করিয়াছিলেন। সংকট এক এক সময়ে আশীর্বাদের ন্যায় কাজ করে। শ্রীরামপুর পুরসভা ২০১৬ সালের অভিজ্ঞতা হইতে পাঠ লইয়া এই বৎসরের গোড়া হইতে ডেঙ্গি ঠেকাইবার জন্য প্রবল চেষ্টা করিয়াছে। এবং ব্যাধিকে হারাইয়া এই বৎসর একটি সুস্থ পরিবেশ তৈয়ারি করিতে পারিয়াছে।
কী করিয়া পারিল? কোনও জাদু করিয়া নহে। পুরসভা যথেষ্ট সময় থাকিতে, বস্তুত গত শীতের শেষ হইতেই ডেঙ্গি প্রতিরোধের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং তাহা কার্যকর করে। লক্ষণীয়, তাহা কোনও এককালীন উদ্যোগ নহে। প্রত্যেক দিনের কর্মসূচি। এবং সেই কাজ কেবল মশার তেল ছড়াইয়া শেষ হইয়া যায় নাই। রীতিমত পরিকাঠামো তৈয়ারি করিয়া, নির্দিষ্ট এলাকা পিছু স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করিয়া, সচেতনতা বাড়াইয়া, আক্ষরিক অর্থেই বাড়ি বাড়ি নিয়মিত প্রচার ও তদারকি করিয়া ডেঙ্গি নিবারণ এবং মোকাবিলার চেষ্টা করিয়াছে। ইহাতে কেবল ব্যাধি প্রশমিত হয় নাই, একটি বাড়তি এবং গভীরতর ফল হইয়াছে। পুরসভা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করিয়াছে। সেই বিশ্বাসের প্রেরণাতেই স্থানীয় নাগরিকরা এই উদ্যোগে শামিল হইয়াছেন। এবং, মানুষের উৎসাহী সমর্থন ও সহযোগ পাইয়া পুরসভার সুবিধা হইয়াছে। এই অভিজ্ঞতা হইতে শিক্ষা সইয়া রাজ্যের অন্যান্য এলাকায় এখন ‘শ্রীরামপুর মডেল’ অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হইতেছে। মনে রাখা দরকার, গত বছর ডেঙ্গির সাংঘাতিক তথ্য সামনে আসিবার ফলেই পুরজন ও পুরকর্তারা ভয় পাইয়াছিলেন, তাহার ফলেই নিবারণী প্রচেষ্টার তাগিদ সৃষ্টি হইয়াছিল। ভয় কখনও কখনও বিশেষ উপকারী। এবং, এই উদ্যোগ করিতে গিয়া প্রাত্যহিক জীবনে কোথায়ও কিছু কম পড়ে নাই। কেবল সচেতন ও পরিশ্রমী হইতে হইয়াছে।
কাজটি সহজ ছিল না। কিন্তু কঠিনতর কাজটি এখনও বাকি। ডেঙ্গি প্রতিরোধে সাফল্য একটি মরশুমের প্রতিরোধ নহে। ইহা দাবি করে প্রাত্যহিক অনুশীলন। এক বার বাহবা পাইয়া যদি উদ্যোগে ভাটা পড়ে, তাহা হইলে ব্যাধি প্রবল শক্তিতে ফিরিয়া আসিতে পারে। সুতরাং উদ্যোগ নিরন্তর চালাইতে হইবে। বস্তুত, সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থারই সেই ভাবে চলিবার কথা। ডেঙ্গি হইলে মশা মারিতে কামান দাগা, শিশুমৃত্যু হইলে মন্ত্রী-সান্ত্রিদের সাড়ম্বর ও সপারিষদ আইসিইউ পরিদর্শন, ভাঙচুর হইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তলব— ইহা কোনও সুস্থ ব্যবস্থা হইতে পারে না। স্বাস্থ্য পরিষেবার যোগ্য পরিকাঠামো এবং সেই পরিষেবা সরবরাহের প্রতি দৈনন্দিন মনোযোগ থাকিলে, এই আকস্মিক ভয়ংকর পরিস্থিতিগুলি আর তৈয়ারি হয় না। দৃষ্টান্ত শ্রীরামপুর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy