Advertisement
০৮ মে ২০২৪
উত্তর সম্পাদকীয়

তিনি ছিলেন রামানন্দের শিল্প-উপদেষ্টা

তাঁকে দেখে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, পাহাড়ের উপর যেন চাঁদের আলো পড়েছে, ভারতীয় চিত্রকলার সেই পুনর্জাগরণের সেই মুহূর্তে নিবেদিতার অজানা ভূমিকার খোঁজ দিলেন রাজনারায়ণ পালতাঁকে দেখে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল, পাহাড়ের উপর যেন চাঁদের আলো পড়েছে, ভারতীয় চিত্রকলার সেই পুনর্জাগরণের সেই মুহূর্তে নিবেদিতার অজানা ভূমিকার খোঁজ দিলেন রাজনারায়ণ পাল

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:০৯
Share: Save:

যে সময়ের কথা আলোচনা করছি, সে সময়ে স্বদেশি চিত্রকলার প্রচারে গুরু দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ ভারতের নিজস্ব শিল্প ঐতিহ্যের প্রচারে বহুল সহায়ক হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসারে নিবেদিত প্রাণ রামানন্দের হাতিয়ার ছিল তাঁর পত্রিকা দু’খানি। সেখানে নিয়মিত দেশীয় চিত্রকলার ছবি ছাপতেন। আর এ কাজে তাঁর কাণ্ডারী হয়েছিলেন নিবেদিতা। এলাহাবাদে কায়স্থ পাঠশালা কলেজের অধ্যক্ষ রামানন্দ ভারতের প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি ছিলেন গভীর শ্রদ্ধাশীল। স্বদেশের সৃজনীশক্তির প্রতি প্রণত, দেশীয় চিত্রকলার একনিষ্ঠ সমর্থক, বিশ্ববিশ্রুত এই সম্পাদক যখন প্রবাসীতে বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা ছবি প্রকাশ করতে মনস্থ করেন, তখনও মর্ডান রিভিউ বের হয়নি। গত শতকের একেবারে গোড়ার দিকের কথা সেটা। ১৯০১ সাল। ঠিক সেই সময় এলাহাবাদে হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তিনি সেখানে লম্বা ছুটি কাটাচ্ছেন। সকালে বিকালে ঘুরতে বেরোন। মাঝে মধ্যে অল্প-স্বল্প গল্প লেখেন। ছেলে-পুলেদের তা’ পড়ে শোনান। অখণ্ড অবসর যাপন বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। এমনই এক দিন প্রাতর্ভ্রমণে আচম্বিতে অবনীন্দ্রনাথের সাথে দেখা হয় রামানন্দের। তিনি তাঁকে তাঁর বাড়ী নিয়ে যান। কথায় কথায় জানান, প্রবাসীকে সচিত্র করতে চান। অবনীন্দ্রনাথ বলেন, সে তো ভাল কথা। রামানন্দ দাবী করেন—আপনাকে ছবি দিতে হবে। অবনীন্দ্রনাথ জানতে চান, ছবি দিলে, তিনি তা’ ছাপবেন কী ভাবে। সে সময় কলকাতায় রঙিন ছবি ছাপবার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কেবল হাফটোন করতেন। আর রঙ্গিন ছবি ছাপবার খরচও তো তখন অনেক। রামানন্দ তাঁকে বলেছিলেন, খরচ যা লাগে লাগুক, সচিত্র কাগজ বের করতেই হবে। চিন্তামণি ঘোষ আছেন, তিনিই ছাপিয়ে দেবেন। চিন্তামণি ঘোষ এলাহাবাদের ইন্ডিয়ান প্রেসের মালিক। ইন্ডিয়ান প্রেস সে সময়ের খুব নামকরা ছাপাখানা। বহু বিখ্যাত গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে। অবনীন্দ্রনাথও তখন আর রাজি না হয়ে পারেননি। রামানন্দ তাঁকে চিন্তামণি ঘোষের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনিও সম্মত হয়েছিলেন ছবি ছাপতে। শুধু অবন ঠাকুরের কাছে চেয়ে নিয়েছিলেন এক জন শিল্পীকে। না করেননি তিনি। পরে যাকে এলাহাবাদে পাঠিয়ে ছিলেন, তিনি যামিনী রায়। বাঁকুড়ার ছেলে। রামানন্দও বাঁকুড়া রাঢ়ী ব্রাহ্মণ বংশের সন্তান।

প্রবাসীতে অবনীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত ছবি ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’। ১৯০৩ সালে দিল্লি দরবার অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে সেখানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আগত চিত্রের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বড় বড় নামজাদা সব আর্টিস্টগণ ছবি পাঠিয়েছিলেন। ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’ও সেখানে গিয়েছিল। শুধু গিয়েছিলই নয়, সকলের নজর কেড়ে রুপোর মেডেলও জয় করে এনেছিল। এ সময়ে প্লেগের করাল গ্রাস কেড়ে নিয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের ফুলের মত ছোট্ট মেয়েকে। শোকের আগুনে দগ্ধ শিল্পী বুকের যাবতীয় ব্যথা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছিলেন তিনি এ চিত্র নির্মাণে। তখনও রামানন্দ কলকাতায় আসেননি।এালাহাবাদেই আছেন। ১৩০৯ এর মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হল সেই ‘শাহজাহানের মৃত্যু প্রতীক্ষা’। এর পর একে একে প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউ-তে বেরোতে থাকে ‘ভারতমাতা’, সীতা, শাহজাহানের তাজ-স্বপ্ন’ প্রভৃতি চিত্রাবলি। আর নিবেদিতা কলম ধরলেন সে সব ছবির চিত্র-পরিচয় রচনায়।

বিংশ শতকের সূচনায় অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল-অসিত কুমার প্রমুখের হাত ধরে বাংলার চিত্রকলায় যে স্বদেশি রীতি ও আঙ্গিকের আবির্ভাব ঘটে, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সে চিত্রকলার প্রচারে যথেষ্ট সুযোগ হয়েছিল। তিনিই সেই ব্যক্তি যিনি নব্যভারতীয় চিত্রকলার সোনালি ফসল দেশের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় শিল্প ক্ষেত্রে নতুনের এই বার্তা বিশ্বের দরবারেও পৌঁছে গিয়েছিল। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকু্র‌, নন্দলাল বসু, অসিত কুমার হালদার, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বেঙ্কটাপ্পার ছবি তিনি নিয়মিত তাঁর পত্রিকা দু’টিতে প্রকাশ করে চলেছিলেন। অর্ধেন্দ্রকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি এই চিত্রকলা গোষ্ঠীভুক্ত ছিলেন, জানিয়েছেন, “রামানন্দবাবু সর্বান্তকরণে এই চিত্র পদ্ধতি প্রচারে সহায়তা না করলে সেই শিল্প আন্দোলন অত দ্রুত অগ্রগতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত কিনা সন্দেহ।” বাংলার নব্য চিত্র-পদ্ধতির জয়যাত্রার পথে রামানন্দের এ কাজে যোগ্য সহযোগী হয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। তবে সহযোগী বললে হয়তো সত্যের অপলাপ হবে খানিকটা। আসলে নিবেদিতাই রামানন্দকে বুঝিয়েছিলেন দেশীয় শিল্পের তাৎপর্য, তার অন্তর্নিহিত গুরুত্ব। প্রথম দিকে বিদেশি ভাবধারার ছবিই তাঁর পত্রিকাতে বেশী জায়গা পেত। নিবেদিতাই তাঁকে ছবির অসারতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। দেশীয় চিত্রকলার উৎকর্ষতার প্রতি সম্পাদকের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেন। সে অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে প্রবাসীর সম্পাদক লিখেছেন, “তিনি আমার কাগজে লেখার কয়েকটি বিষয়ে আমার চোখ ফুটিয়ে ছিলেন। আমি প্রথমে রবি বর্মার ছবির প্রতিলিপি এবং সেই জাতীয় অন্য ছবির প্রতিলিপি ছাপতাম। তিনি ক্রমাগত আমার সহিত তর্কযুদ্ধ করিয়া আমার এই বোধ জন্মান যে, রবি বর্মা ও তদ্বিধ অন্য ছবির রীতি ভারতীয় নহে এবং পাশ্চাত্য রীতির চিত্র হিসাবেও সেগুলি উৎকৃষ্ট নহে”। (‘ভগিনী নিবেদিতা’ উদ্বোধন, মাঘ, ১৩০৫) এর পর থেকেই রামানন্দ নিও-বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টের পুরোধা শিল্পীকূলের ছবি প্রকাশ করতে বেশি উদ্যোগী হন। আর নিবেদিতা এগিয়ে আসেন সে সব চিত্রের ‘পরিচিতি’ রচনায়। ছবি জোগাড় থেকে শুরু করে ছবির খুটিনাটি বিষয়ে বিশ্লেষণ—সব ব্যাপারেই তিনি হয়ে ওঠেন রামানন্দের যথার্থ শিল্প-উপদেষ্টা।

জন্মলগ্ন থেকেই মর্ডান রিভিউ-এর পাতায় চিত্র-সমালোচক রূপে নিবেদিতা আমৃত্যু অবনীন্দ্রনাথ ও অন্য তরুণ শিল্পীদের দেখিয়ে দিতেন কোথায় কি বর্জন করতে হবে, আর কোন পথ অনুসরণ করতে হবে। ইতিহাস, জাতিবিজ্ঞান, চারুকলা—সর্বত্র আমাদের আধুনিক গবেষণাকে অগ্রসর করার জন্য, উৎসাহ দেবার জন্য—সমালোচনা ও সংশোধন করার জন্য নিবেদিতা সর্বদা আগ্রহী ছিলেন। তার এ সব কর্মকাণ্ডের পিছনে প্রত্যক্ষদর্শী ইতিহাসচার্য যদুনাথ সরকার দেখেছিলেন অকদর্প দেশ সেবার প্রেরণা। (আচার্য যদুনাথ সরকার, ‘ভগিনী নিবেদিতা’)। ঠিক একই কথা বলেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসুও।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলায় অঙ্কন প্রণালী বলতে ইউরোপীয় আর্ট ছাড়া গতি ছিল না। ভারত শিল্প তখন সবার অগোচরে। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর উৎসাহে আর্ট স্কুলের ভাইস-প্রিন্সিপাল ইটালিয়ান আর্টিস্ট গিডার্ড সাহেবের কাছেই তাঁর আঁকা শিখবার জন্য প্রথম যাতায়াত। তখন অবনীন্দ্রনাথ যথেষ্ট বড়। বিবাহিত পুরুষ। কিন্তু ইচ্ছা হয়েছে আঁকা শিখবেন। তবে বেশি দিন সেখানে ধৈর্যের লাগাম ধরে রাখতে পারলেন না। আর্ট স্কুলের রীতি মেনে ধীরে ধীরে তুলি টানা,আর রং মেলানোর শিক্ষা অচিরেই তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল। মাস ছ’য়ের মধ্যেই সাহেবের মাস্টারির চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাড়িতেই তৈরি করে ফেললেন নিজস্ব স্টুডিও। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সবে ‘চিত্রাঙ্গদা’ শেষ করেছেন। মঞ্চস্থ হবে তা। অবনীন্দ্রনাথের ওপর ভার পড়ল চিত্রাঙ্গদার জন্য ছবি আঁকার। তখন খানিক সাহস হয়েছে তাঁর। রাজি হয়ে গেলেন। মঞ্চস্থ হল ‘চিত্রাঙ্গদা’।

(চলবে)

শিক্ষক, মহাদেবানন্দ মহাবিদ্যালয়

‘উত্তর সম্পাদকীয়’ বিভাগে লেখা পাঠান এই ইমেল-এ edit.msd@abp.in ইউনিকোড হরফে লেখা পাঠালেই ভাল হয়। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sister Nivedita Ramananda Chatterjee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE