তামিল কার্টুনিস্ট জি বালা।
আর কত বার, আর কত দিন এবং আর কত রকম ভাবে নিজেদের সংবিধানকে নিজেরাই অপদস্থ করব আমরা? প্রত্যেক নাগরিক চান মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত হোক। সংবিধান তা সুনিশ্চিত করেছে। সংবিধান নির্দিষ্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপায়ণের জন্য প্রশাসন গঠিত হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তারা মাঝেমধ্যেই ভুলে যান যে, সংবিধানের প্রতিই সর্বাগ্রে দায়বদ্ধ তাঁরা। প্রশাসনিক কর্তারা এও সম্ভবত ভুলে যান যে, পেশাগত পরিচয়টা বাদ দিলে, তাঁরাও দেশের সাধারণ নাগরিকই, সুনিশ্চিত মৌলিক অধিকার নামক রক্ষাকবচটির প্রয়োজন তাঁদেরও পড়তে পারে।
অম্বিকেশ মহাপাত্রের নামটা আমাদের সকলের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত। মুখ্যমন্ত্রীর ‘ব্যঙ্গচিত্র’ ই-মেলে আদান-প্রদান করে রাতবিরেতে পুলিশের খপ্পরে পড়তে হয়েছিল অধ্যাপক অম্বিকেশকে। এ দৃষ্টান্ত বেশ কয়েক বছরের পুরনো ঠিকই। কিন্তু প্রায় নিয়মিতই দেশের কোনও না কোনও প্রান্তে, কোনও না কোনও অম্বিকেশকে এই ভাবেই হেনস্থা করে প্রবণতাটা বহাল রাখছে আমাদের দেশের প্রশাসন। দিন কয়েক আগে উত্তরপ্রদেশের মেরঠে এক সাংবাদিক এমন একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়েছিলেন, যাতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি ব্যঙ্গ ছিল। পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেছে ওই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। এই ঘটনার আগের দিনই তামিলনাড়ুতে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এক বেকার যুবককে, নেট-দুনিয়ায় যিনি ব্যঙ্গ করেছিলেন সেই প্রধানমন্ত্রীকেই। তার কয়েক দিনের মধ্যেই আবার শিরোনামে তামিলনাড়ু। ঋণের দায়ে জর্জরিত কৃষক পরিবার জেলাশাসকের দফতরের সামনে একযোগে আত্মাহুতি দেওয়ার আগে পর্যন্ত সুদখোর মহাজনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করেনি তিরুনেলভেলি জেলার প্রশাসন। এই প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার দিকে তীব্র শ্লেষ ছুড়ে দিয়ে কার্টুন এঁকেছিলেন জনপ্রিয় ব্যঙ্গচিত্রী জি বালা। কার্টুন যত ভাইরাল হয়েছে, প্রশাসনের অস্বস্তি ততই বেড়েছে। অবশেষে গ্রেফতার করে নেওয়া হল তামিল কার্টুনিস্টকে।
আরও পড়ুন
অম্বিকেশ-ছায়া চেন্নাইয়ে, গ্রেফতার কার্টুনিস্ট
পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, ভারতের সব প্রান্তেই একই রকম অসহিষ্ণুতা প্রকট আজ। সংবিধান অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীন অধিকার দিয়েছে নাগরিককে। কিন্তু কারও মত অপছন্দ হলেই, যে কোনও উপায়ে তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে দেওয়ার জন্য এ দেশের প্রশাসন আজ যেন সদা-উদ্যত।
এ আসলে এক ধরনের আতঙ্কের ফল, যাকে আজকের দুনিয়ায় ‘প্যারানইয়া’ বলে ডাকা হয় বৃহত্তর অর্থে। ‘প্যারানইয়া’ আসলে অযথা এবং অমূলক আতঙ্কে ভোগার অন্য নাম। আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমী দেশের প্রশাসনই এই অমূলক আতঙ্কে সবচেয়ে বেশি ভোগে বলে আমরা জানতাম। ‘প্যারানইয়া’য় ভোগে বলেই যাঁকে-তাঁকে বিমানবন্দরে তল্লাশির নামে হেনস্থা করা হয়, ‘প্যারানইয়া’য় ভোগে বলেই আচমকা বেশ কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের আমেরিকা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
আমাদের দেশে এসে সেই ‘প্যারানইয়া’ই একটু নতুন রূপ নিয়েছে বলে প্রতীত হয় আজ। সন্ত্রাসবাদের আতঙ্কে যত না ভোগে আমাদের প্রশাসন, তার চেয়ে অনেক বেশি ভোগে নিজেদের মান-সম্মানে ধাক্কা লাগার আতঙ্কে। নাগরিককে স্বাধীন ভাবে মতপ্রকাশ করতে দিলে বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভের কথা বিনা বাধায় প্রকাশ্যে আনতে দিলে মান-সম্মান আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, এমনই এক আতঙ্কে সম্ভবত ভোগেন আমাদের দেশের প্রশাসনিক কর্তারা। সেই কারণেই অপছন্দের কণ্ঠস্বরের আভাস মিললেই সজোরে গলা টিপে ধরতে তৎপর হয়ে পড়ে এ দেশের প্রশাসন। সংবিধান স্বীকৃত মতপ্রকাশের স্বাধীন অধিকার চুলোয় গেলে যাক, প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের ‘সম্মান’ অক্ষুণ্ণ রাখতেই হবে— ভাবখানা অনেকটা এমনই।
‘প্যারানইয়া’ নিয়ে যে দেশকে সবচেয়ে বেশি গালিগালাজ শুনতে হয়, সেই আমেরিকাও কিন্তু ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ-কটাক্ষের প্রতি এত অসংবেদনশীল নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়ায় কিন্তু দেদার রঙ্গতামাশা চলতেই থাকে। তবে ট্রাম্পকে ব্যঙ্গ করেছেন বলে কাউকে গ্রেফতার হতে হয়েছে, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু ভারতে সম্প্রতি এমনটাই দেখা যাচ্ছে।
এত অসহিষ্ণুতা কেন? সহনশীলতার এত অভাব কেন? প্রশাসনের বা রাজনীতির কর্তাদের মান-সম্মান কি এতই ঠুনকো? নাগরিককে অবাধে মতপ্রকাশ করতে দিলে সরকারি কর্তাদের মান-সম্মান ধসে পড়বে? আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি এবং হীনমন্যতা থাকলেই এমন আতঙ্ক বাসা বাঁধে। সেই আতঙ্ক থেকেই নাগরিককে এই ভাবে ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে হয়। ভারতের সাংবিধানিক কাঠামোর সুরক্ষার স্বার্থেই এই আত্মবিশ্বাসহীন প্রশাসনিক কর্তাদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি হয়ে পড়ছে দিন দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy