Advertisement
১১ জুন ২০২৪

সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ

অনেকেই তখন প্রশ্ন করতেন, ‘দাদা’ কেমন রাষ্ট্রপতি হবেন? মনে হত, আর যা-ই হোক তিনি জৈল সিংহের মতো রাষ্ট্রপতি কখনওই হবেন না, যিনি রাইসিনা হিলস-এ বসে রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিলেন।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০১৭ ০০:২৭
Share: Save:

প্র ণব মুখোপাধ্যায় যেখানেই যান না কেন তাঁর অ্যাটাচিতে সব সময়ই থাকে একটি পকেট ভারতীয় সংবিধান। অভ্যেসটা রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর নয়, বহু দিনের লালিত। সম্ভবত ইন্দিরা-যুগ থেকেই। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের পর যখন রাইসিনা হিলস-এ প্রবেশ করলেন তখন তিনি সত্যি সত্যিই হয়ে গেলেন রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রধান। একদিন গিয়ে দেখলাম তিনি মন দিয়ে পড়ছেন হেনরি কিসিঙ্গারের হোয়াইট হাউস ইয়ার্স। সামনে টিভির পরদায় সংসদের কোলাহল। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সেটাই ছিল প্রথম সংসদীয় অধিবেশন। সংসদের অধিবেশনে তাঁর অতি-সক্রিয় ভূমিকা নিজেই খুব মিস করছেন। আবার তুলনামূলকভাবে কম ব্যস্ত জীবনটাকেও মানিয়ে নিতে চাইছিলেন। এত সক্রিয় রাজনৈতিক নেতা, যিনি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিরই সদস্য ছিলেন কত দীর্ঘ সময়, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিও হয়েছেন। ইন্দিরা-নরসিংহ রাও থেকে মনমোহন সিংহ বিভিন্ন সরকারের শীর্ষমন্ত্রী শুধু নয়, ‘নাম্বার-টু’ ব্যক্তিত্ব। যখন সাংবিধানিক নাম্বার-ওয়ান হয়ে গেলেন, তখন ধীরে ধীরে নিজে এক যোগ্য রাষ্ট্রপতি হয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করেন।

অনেকেই তখন প্রশ্ন করতেন, ‘দাদা’ কেমন রাষ্ট্রপতি হবেন? মনে হত, আর যা-ই হোক তিনি জৈল সিংহের মতো রাষ্ট্রপতি কখনওই হবেন না, যিনি রাইসিনা হিলস-এ বসে রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চেয়েছিলেন। আবার প্রতিভা পাটিলের মতো অভিমতহীনও হবেন না। সংবিধানের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে তিনি এক ‘সৃজনশীল’ রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেষ্টা করবেন। ভারতীয় সংবিধানের মধ্যেই কিন্তু রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় প্রশস্ত বিতর্কিত ধূসর এলাকা আছে। অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশন-এ একে বলা হয়েছে ‘ডিসক্রিশনারি’ ক্ষমতা।

পাঁচ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর বলা যায়, ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি সফলতার সঙ্গে স্টার মার্কস পেয়ে উত্তীর্ণ। তাঁর উপস্থিতি ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট। আবার মোদী সরকারের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির প্রকাশ্য সংঘাতের নজিরও থাকেনি। কোনও সাংবিধানিক সংকট তিনি হতে দেননি।

বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ একমাত্র রাষ্ট্রপতি যিনি দু’টি টার্ম পেয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে নেহরুর প্রথম রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছিল। বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের ভাষায় ভারতীয় সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় ‘প্রাণ’ আছে। নেহরু বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা আসলে ‘প্রাণহীন’। হিন্দু কোড বিল এবং জমিদার প্রথা অবলুপ্তি আইন দু’টি নিয়েই রাজেন্দ্রপ্রসাদ প্রত্যক্ষ বিরোধে যান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। নেহরু এক গুচ্ছ আইন-উপদেষ্টার মতামতকে সাংবিধানিক অস্ত্র করে রাজেন্দ্রপ্রসাদকে পরাস্ত করেন। তার পর ’৫২ এবং ’৫৭ সালের দুটো ভোটে মানুষের সমর্থন নিয়ে তিনি তাঁর কর্তৃত্বকে সংসদীয় গণতন্ত্রের নব্য ভারতীয় কাঠামোয় সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্তী কালে বহু বিশেষজ্ঞ নাম দিয়েছেন এ হল ‘নেহরুভিয়ান প্রেসিডেন্সি’।

আসলে সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতায় বেশ কিছু জায়গা আছে যার ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। এটা বুঝেই ৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উপর ৪২ এবং ৪৪তম সংশোধনী আনেন ইন্দিরা গাঁধী। নেহরু যে ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের উত্তরাধিকারী হতে চান, পরবর্তী কালে সেই পথ ধরেই ক্যাবিনেটের দড়ি দিয়ে আরও ভাল করে বেঁধে দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা। মার্কিন রাজনীতি-বিজ্ঞানী ডগলাস ভার্নে বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান, প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান। চাইলে ব্রিটেনের রানিও তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। ভারতেও সরকার বেশ কয়েক বার সংখ্যালঘু হওয়ায় রাষ্ট্রপতির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।

১৮৮৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও সরকার গঠনে রানির ভূমিকা নিয়ে প্রবল বিতর্ক হয়। সংখ্যালঘু সরকারের প্রধানমন্ত্রী লর্ড সলসবেরি রানি ভিক্টোরিয়াকে বলেছিলেন, ‘আপনি সার্বভৌম অধীশ্বর। যার যোগ্যতায় আপনি সন্তুষ্ট হবেন তাকেই প্রধানমন্ত্রী করবেন।’ রানি সে বার সলসবেরির পক্ষে রায় দেন। রানি প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে পারতেন, কিন্তু রানি ও প্রধানমন্ত্রীর সে সব বৈঠকের কোনও ‘মিনিটস’ থাকত না। কোনও ব্যক্তিগত সচিবও থাকতেন না। মার্গারেট থ্যাচার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, যাঁরা ভাবেন রানির কোনও ভূমিকা নেই, তাঁরা ভুল ভাবেন।

২০১৪ সালে মোদীর অভূতপূর্ব সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রণববাবুকে এই সব বিতর্ক থেকে রক্ষা করেছে। পাঁচ বছরে বেশ কিছু বিষয়ে তাঁর সঙ্গে সরকার বা মোদীর মতপার্থক্য থাকলেও তা গোপনই থেকেছে।

ক’জন জানেন কাশ্মীরে সেনাকে মনুষ্যঢাল হিসাবে ব্যবহার করায় প্রণববাবু ক্ষুব্ধ হন? তিনি মনে করেন সেনাবাহিনীর প্রধান কাজ সীমান্তে থেকে দেশের সুরক্ষা। উপত্যকায় দেশের আইনশৃঙ্খলা সামলানো নয়। সে দিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের এক শীর্ষ সেনা-অফিসার বলেছিলেন, ‘মশাই আপনি কি জানেন, প্রণববাবু সেনাকর্তাদের ডেকে কাশ্মীর হ্যান্ডলিং নিয়ে তাঁর অসন্তোষ জানিয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন সরকারকে।’ প্রণববাবু কথায় কথায় ফাইল ফেরত পাঠিয়ে সংবাদমাধ্যমে কোনও নাটকীয় প্রচারের পথে যাননি। কিন্তু তিনি বহু ফাইল নিয়ে সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। আলোচনা করে সরকারের সিদ্ধান্ত বদলানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি কখনও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অপসারণ নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গেছেন। আবার সংসদ এড়িয়ে অর্ডিন্যান্সে সই করতে রাজি হননি। মৃত্যুদণ্ডে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য প্রণববাবুর অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত তো আদালতের বিভিন্ন রায়ের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভায় গৃহীত হয়। বিচারবিভাগীয় এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া থাকে। রাষ্ট্রপতি তা অবজ্ঞা করতে পারেন না। আবার সরকার যত সংখ্যায় মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ পাঠায় তার মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আইনি সংশয় থাকলে প্রণববাবু তা ফেরতও পাঠিয়েছেন।

কালামের মতো রাষ্ট্রপতি অনেক সময় ফাইল ফেরত পাঠিয়ে তাঁর মিডিয়া উপদেষ্টার মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমে জানিয়ে নিজেকে ‘বিক্ষুব্ধ-জনগণের রাষ্ট্রপতি’র ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় হন। কিন্তু কালামের ফেরত পাঠানো সেই সব ফাইল ক্যাবিনেট আবার ফেরত পাঠালে তিনি সই করতে বাধ্য হন। সে কথা কিন্তু খবর হয়নি। প্রণববাবু কালামের স্টাইলে ‘রাগী রাষ্ট্রপতির’ ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাননি মিডিয়ার মাধ্যমে। আবার ‘টেক্সটবুক ম্যান’ প্রণববাবু প্রতিভা পাটিলের মতো প্রশ্নহীন আনুগত্যও দেখাননি। তিনি সাংবিধানিক সীমার মধ্যে থেকেও মোক্ষম কামড় দিয়েছেন। সংসদের মধ্যরাতের অনুষ্ঠানে বলতে ছাড়েননি, আইনের খসড়া তাঁরই করা— যখন তিনি কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এবং, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী সে সময়ে বিলের বিরোধিতা করেছিলেন। গোটা দেশে যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার আবহ তৈরি হয়েছে, চাণক্যের বুদ্ধিতে বার বার সেই প্রশ্নে তিনি আঘাত হানছেন।

ভারতীয় গণতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিরও একটি পরিসর আছে। প্রণববাবুর পাঁচ বছর বুঝিয়ে দিল, গণতন্ত্রে এই ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ সর্বদাই প্রয়োজনীয়। ইউ পি এ জমানায় প্রতিভা পাটিলকে মনোনীত করে কংগ্রেস যে ভুল করেছিল, আজ বি জে পি রামনাথ কোবিন্দকে মনোনীত করেও সেই একই ভুল করল। প্রণববাবু তাঁর মেধা ও দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন।

রাষ্ট্রপতি ভবনের এই সাংবিধানিক মর্যাদাটুকু রক্ষা করা বিশেষ প্রয়োজন গণতন্ত্রের স্বার্থেই। ভয় হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ভবন আবার না বি জে পি-র একটি শাখা অফিসে পরিণত হয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE