চলচ্চিত্র নির্মাতা অনীক দত্ত।
খুব বড় মুখ করে আমরা ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’-এর আখ্যান বিবৃত করি। কিন্তু বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য বা ভিন্ন ভিন্ন মত সহ্য করার মতো মানসিক ঔদার্য আমাদের অনেকেরই নেই। কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে নন্দন-রবীন্দ্র সদন চত্বরে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় নিজের মতামত খোলাখুলি ব্যক্ত করে চলচ্চিত্র নির্মাতা অনীক দত্ত যে রকম ঘোর দুর্বিপাকে পড়ে গিয়েছেন বলে প্রতীত হচ্ছে, তা আমাদের মানসিক ঔদার্যের ক্রমাবনতিরই ইঙ্গিত বহন করে।
অনীক দত্ত নিজের মতামতটা জানিয়েছেন। সে মতামত ঠিক হতে পারে, ভুলও হতে পারে। অনীক দত্তের মতামত কারও পছন্দ হতে পারে, কারও অপছন্দও হতে পারে। পছন্দ হলে কেউ সমর্থন ব্যক্ত করতেই পারেন। পছন্দ না হলে বিরোধীতাও করা যেতে পারে। কিন্তু নিজের মতটি খোলাখুলি জানিয়ে দেওয়ার পর থেকে যে রকম ভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন অনীক দত্ত, সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ধরনের ট্রোলের সম্মুখীন হচ্ছেন, এ রাজ্যের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা-মন্ত্রীও যে ভাবে অনীক দত্তকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে দিচ্ছেন, তা সভ্য তথা মুক্ত সমাজের রীতি বহির্ভূত।
আমার মতের সঙ্গে আপনার মত মিললে আপনি মিত্র, না মিললেই আপনি শত্রু— এমন চিন্তাধারা কোনও সুস্থ সমাজের পরিচয় দেয় না। মতের অমিল হলেই কাউকে শত্রু হিসেবে দেগে দেওয়া কোন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় দেয়? চলচ্চিত্র নির্মাতা অনীক দত্তের মনে হয়েছে যে, চলচ্চিত্র উৎসব চত্বরে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখচ্ছবির বাহুল্য দৃষ্টিনন্দন নয়। তাঁর মনে হয়েছে যে, সংস্কৃতির পীঠস্থানে শাসক ভজনার বাড়াবাড়ি চলছে এবং এই ‘বাড়াবাড়ি’ অনুচিত। তিনি অকপটে নিজের মনের কথা প্রকাশও করে দিয়েছেন। অনীক দত্তের এই ‘মনের কথা’কে ধ্রুব সত্য হিসেবে ধরে নিতে হবে, এমন নয়। কিন্তু এই মন্তব্যের জন্য অনীক দত্তকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে বা বিরোধী দলের তল্পিবাহক আখ্যা দিয়ে দিতে হবে, এ-ও মেনে যায় না।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
শাসক দলের যে নেতারা গত কয়েক দিনে রীতিমতো খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত করলেন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে, সর্বাগ্রে সেই নেতাদের খেয়াল করা উচিত, তাঁদের দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু অনীক দত্তের মন্তব্য নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয় দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বার বারই সহিষ্ণুতার প্রশ্নে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে থাকেন। বিভিন্ন মতের সমাহারই আসলে ভারতীয়ত্ব, বিপুল বৈচিত্রের সমন্বয়েই আসলে ভারত নির্মিত— দেশের নানা প্রান্তে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ সব কথা বার বার বলে এসেছেন। দলনেত্রীর এই বার্তাগুলোকে যদি বিন্দুমাত্র সম্মান করতেন, তা হলে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা অনীক দত্তকে একঘরে করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করতেন না।
আরও পড়ুন: কেউ কেউ বলছেন এ বার আমাকে ভাতে মারা হবে, মারবে, রুটি...
আবার বলি, অনীক দত্তের মন্তব্য ঠিক না ভুল, তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। অনীকের যেমন কোনও বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করার অধিকার রয়েছে, তেমনই অনীক সম্পর্কে বিরূপ মত প্রকাশের অধিকারও অন্যদের রয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র ভিন্ন মত পোষণ করার জেরে কাউকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা হবে, এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বার বার যে সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের তত্ত্ব উচ্চারণ করছেন, তা যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামীরা অনুসরণ করতেন, তা হলেই এই দুর্ভাগ্যজনক ছবিটা তৈরি হত না।
আরও পড়ুন: কে বড়, মুখ্যমন্ত্রীর ছবি না চলচ্চিত্র, বিতর্কে তোলপাড় রাজ্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy