Advertisement
E-Paper

বিজ্ঞানের জন্য, সকলের জন্য

সারা পৃথিবীর যা দাবি, সে দাবি ভারতেরও। তবে ভারতে এই মিছিলের যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের আরও কিছু বলার আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা যে আবেদনপত্রটি পেশ করেছেন, তাতে পরিবেশচিন্তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে অন্য অনেক কথা।

পলাশ বরন পাল

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০

গত ৯ অগস্ট, ২০১৭, ভারতের নানা শহরে শুরু হল এক অভূতপূর্ব পদযাত্রা। বিজ্ঞানের জন্য। ২২ এপ্রিল পৃথিবীর অনেক শহরে এ রকম মিছিল বেরিয়েছিল। যে কোনও কারণেই হোক, ভারত সেই পৃথিবীব্যাপী উদ্যোগে সাড়া দিতে পারেনি সে সময়ে। প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে, কয়েক জন অগ্রগণ্য বিজ্ঞানীর আহ্বানে, ‘ব্রেকথ্রু সায়েন্স সোয়াইটি’ নামক বিজ্ঞান সংগঠনটির উদ্যোগে আয়োজন করা হল ভারতীয় মহামিছিলের। অভাবনীয় সাড়া পাওয়া গেল, সারা ভারতের ৮৩টি শহরে পনেরো হাজারেরও বেশি মানুষ নেমে এলেন রাস্তায়, বিজ্ঞানের ডাকে।

কেন এই মিছিল? এই বিজ্ঞান-মিছিলের ডাক দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। ২০১৬ সালে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে সব বক্তৃতা দেন, তাতে পরিষ্কার হয়ে যায় যে বিশ্বের উষ্ণায়নের সমস্যাটিকে তিনি বুজরুকি মনে করেন, নির্বাচনে জিতলে পরিবেশ সংক্রান্ত যে কোনও প্রস্তাবে বাধা দেবেন। তাঁর কথাবার্তায় আতঙ্কিত হয়ে মার্কিন বিজ্ঞানীরা ডাক দেন মিছিলের। দশ লক্ষেরও বেশি মানুষ শামিল হন বিভিন্ন শহরে। তাঁদের দাবি, বিজ্ঞানের গবেষণা, বিজ্ঞানের আলোচনার ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত করতে হবে, বিজ্ঞানের দাবি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না মূর্খ জঙ্গিপনায়।

অবশ্য, এ দাবি শুধু বিজ্ঞানীদের নয়। জল-মাটি-বাতাস দূষিত হলে, জ্বালানি অমিল হলে তাতে ভুক্তভোগী হবেন পৃথিবীর সমস্ত মানুষ, বা হয়তো আরও জোর দিয়ে বলা উচিত, এতে বিপর্যস্ত হবে সব রকমের সব প্রাণী সমেত গোটা গ্রহটির ভবিষ্যৎ। সেই জন্যই পৃথিবী জোড়া মিছিল। সেই জন্যই এই মিছিলে যাঁরা যোগ দেন, তাঁরা সবাই বিজ্ঞানী নন।

সারা পৃথিবীর যা দাবি, সে দাবি ভারতেরও। তবে ভারতে এই মিছিলের যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁদের আরও কিছু বলার আছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁরা যে আবেদনপত্রটি পেশ করেছেন, তাতে পরিবেশচিন্তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে অন্য অনেক কথা। বলা হয়েছে, ভারতের জিডিপির, অর্থাৎ সর্বমোট ব্যয়ের শতকরা এক ভাগেরও কম পরিমাণ বরাদ্দ হয় বিজ্ঞানের শিক্ষা ও গবেষণার খাতে। বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা অনেক বেড়ে গেছে, তার বলি হয়েছেন বহু মানুষ।

এ কথাগুলো শুধু বিজ্ঞানের মুখ চেয়ে বলা নয় এবং বিজ্ঞানীদের কোনও সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বলা নয়। অসহিষ্ণুতা বাড়লে অশান্তি শুধু বিজ্ঞানীর নয়, সবার। শিক্ষাক্ষেত্রে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তা শুধুই বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়ের শিক্ষার জন্য নয়। এ টাকার অংশ যায় শিল্প-সাহিত্য-ভাষা থেকে শুরু করে ইতিহাস-সমাজবিদ্যা-অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়েও। যায় নানা রকমের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণে, আইন-বাণিজ্য-ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি আরও অনেক কিছুতে। সবচেয়ে বড় কথা, এই টাকাতেই নির্বাহ হয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা, যেখানে এত সব ভাগবিভাগ নেই, একই পাঠ্যক্রমে নানা বিষয়ের বুনিয়াদি শিক্ষা দেওয়া হয় ছাত্রছাত্রীদের। এই সব মিলিয়েই আমাদের শিক্ষাখাতের ব্যয় খুবই কম। গোটা সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে শিক্ষার ভিতের ওপর, তাই শিক্ষায় বেশি নজর দেওয়ার অর্থ গোটা সমাজেরই মঙ্গলসাধন।

আবেদনপত্রে রয়েছে অন্যান্য কয়েকটি দেশের সঙ্গে আমাদের তুলনা। বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য দক্ষিণ কোরিয়া ব্যয় করে মোট জিডিপির ৪.১৫ শতাংশ, জাপান ৩.৪৭ শতাংশ, ইত্যাদি। আগেই বলেছি, সেখানে আমাদের ব্যয় এক শতাংশেরও কম, মোটামুটি ০.৮ শতাংশ। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাজেটে যে পরিমাণ টাকা ছাঁটাই করা হয়েছে, তা থেকে মনে হয় এই পরিমাণটা নিম্নমুখী। আবেদন করা হয়েছে, প্রবণতার মুখ উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে মোট খরচের তিন শতাংশ এই খাতে বরাদ্দের কথা ভাবা হোক।

শিক্ষার সামগ্রিক উন্নতি না হলে যে বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি হয় না, সে কথা ভুলে যাননি এই আবেদনপত্রের প্রণেতারা। তাঁরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও নিরক্ষরতা দূর করে উঠতে পারিনি আমরা। স্কুল পাশের সংখ্যা দুঃখজনকভাবে কম। শিক্ষার কাঠামোটাকেই নাড়া দিতে হবে গোড়া থেকে, এ কথা তাঁরা বলেছেন। এখানে প্রয়োজন অর্থের। এখানে অন্য বহু দেশের সঙ্গে তুলনায় আমাদের পরিস্থিতি শোচনীয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক, উত্তর কোরিয়া, নিউজিল্যান্ড, বেলজিয়াম ইত্যাদি বেশ কয়েকটি দেশের উল্লেখ আছে আবেদনপত্রে, শিক্ষা খাতে তাদের ব্যয় ৬ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। কিউবায় ব্যয় ১২ শতাংশের একটু বেশি। সেখানে ভারত ব্যয় করে ৩ শতাংশ। দাবি করা হয়েছে, এই পরিমাণটা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হোক। মনে রাখবেন, এই দাবি শুধু বিজ্ঞানের জন্য নয়, সামগ্রিক ভাবে শিক্ষার জন্য। বুনিয়াদি শিক্ষা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের উচ্চশিক্ষাও এই দাবির আওতায় পড়ে। অতএব দেখছেন, এই যে মিছিল হল, এই যে দাবি পেশ করা হল, তা শুধুই বিজ্ঞানের জন্য নয়, সবার জন্য।

কেউ বলতে পারেন, ‘টাকার পরিমাণ বাড়ানোর কথাটা বলা সহজ, করা তত সহজ নয়। আমাদের মতো গরিব দেশে এত বাড়তি অর্থ আসবে কোথা থেকে?’ এ কথা নিশ্চয়ই ঠিক যে মুখ থেকে কথা নিঃসৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রূপায়ণ সম্ভব নয়। কিন্তু একটু আগে যে সব দেশের উদাহরণ দিয়েছি, তারা সবাই খুব ধনী দেশ নয়। কিউবা ধনী নয়। বতসোয়ানা যদি তাদের মোট খরচের শতকরা ৭ ভাগের বেশি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করতে পারে, বুরুন্ডি যদি ৬ শতাংশ করতে পারে, তা হলে আমরা ৩ শতাংশের বেশি খরচ করতে পারব না কেন?

আরও একটা কথা। বিজ্ঞানীরা যে আবেদনপত্র পেশ করেছেন, তাতে এই বিষয়ের উল্লেখ নেই, এটা আমার সংযোজন। পৃথিবীতে কোন দেশ সবচেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় সামরিক সরঞ্জাম আমদানির জন্য, তা কি জানেন? এর উত্তর, আমাদের এই ভারত। টানা বহু বছর ধরে এই তালিকায় ভারত শীর্ষে। ঘনিষ্ঠ প্রতিযোগী কেউ নেই। যে দেশ সামরিক ব্যয়ের হিসেবে সবচেয়ে শীর্ষের তালিকায় পড়ে, শিক্ষার ব্যাপারে সে কি আরও একটু ওপর দিকে উঠতে পারে না।

এ আবেদন শুধু বিজ্ঞানের জন্য নয়, শিক্ষার জন্য। এ আবেদন শুধু বিজ্ঞানীদের নয়, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সকলের। এক দিনের মিছিলেই ম্যাজিকের মতো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এ কথা কেউ ভাবছেন না। প্রয়োজনে আবার পথে নামতে হবে। সবাইকে। ‘রাস্তাই একমাত্র রাস্তা’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে।

Science Education
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy