Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

ধ্বংসের মুখোমুখি

দক্ষিণ কলিকাতার স্কুলটির সাম্প্রতিক ঘটনা অতি ভয়ংকর। তাহা পড়িয়া শিহরিয়া ওঠা ছাড়া গতি নাই। অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ হইলে দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি জরুরি।

শেষ আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:৪০
Share: Save:

প্রতি দিনের সংবাদ বলিতেছে, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যয়ের ঘোষণা এক ভিন্ন অর্থে ফিরাইয়া আনিবার দিন আজ: ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা। কলিকাতা শহরে শিশু নিগ্রহের ক্ষেত্রেই হউক, আর অটো হামলার ক্ষেত্রেই হউক, প্রতি দিন স্পষ্ট— বর্তমান সমাজ যে ভয়ানক অবক্ষয়ের অতল ছুঁইয়াছে, সেই অতল এক বার ছুঁইয়া ফেলিলে তাহা হইতে মাথা তোলা অসম্ভব। এক চূড়ান্ত বিবেকশূন্যতা ও বিবেচনাহীনতার সমুদ্রে ভাসিতে ভাসিতে এই সমাজ জানিয়া গিয়াছে, প্রথমত এখানে আইনের শাসন নাই, দ্বিতীয়ত সেই শাসনের ছিটেফোঁটা দেখিলেই তাহার টুঁটি টিপিয়া মারা সম্ভব। অটোচালক প্রৌঢ়া যাত্রীকে নিগ্রহ করিতেছেন, প্রৌঢ়ার পুত্র আপত্তি করিলে তাই অসংখ্য লোক তাড়া করিয়া তাঁহাদের বাড়ির সামনে দিনভর গুন্ডাদের তাণ্ডব চালাইতেছেন, কেহ আটকায় নাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছাত্রদের ফেল করাইয়াছেন, এই ‘অপরাধে’ রাজনীতি-ধন্য গবেষক তাঁহার অফিস-ঘরে ঢুকিয়া থাপ্পড়ের পর থাপ্পড় মারিয়া অধ্যাপককে সবক শিখাইতেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা প্রশাসনের কর্তা এই সংবাদে এক বিন্দু লজ্জিত বোধ করিতেছেন না। নামজাদা বিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কোনও শিক্ষক নির্যাতন করিয়াছেন শুনিয়া অভিযুক্তের শাস্তির ব্যবস্থা করিবার পরিবর্তে অভিভাবকরা হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে সমাজবিরোধীদের আদলে নিজেদের সংগঠিত করিয়া শিক্ষককে মারিবার বন্দোবস্ত করিতেছেন। পুলিশকে হুকুম করিতেছেন অভিযুক্তকে তাঁহাদের হাতে ‘তুলিয়া দিতে’। পুলিশ সেই হুকুম না শোনায় পুলিশকেই পিটাইয়া হাতের সুখ করিতেছেন। ইহাকে নিজের হাতে আইন তুলিয়া লওয়া বলিলে পুরোটা বলা হয় না। বলা যায়, আইনের বিধি সমাজের বা রীতি সামগ্রিক ভাবে পদদলিত করিয়া যথেচ্ছাচারের অধিকার প্রতিষ্ঠা চলিতেছে। এই নৈরাজ্য, এই ধ্বংসকামিতা আজ নিয়মিত দস্তুর।

মনে রাখিতে হইবে, দক্ষিণ কলিকাতার স্কুলটির সাম্প্রতিক ঘটনা অতি ভয়ংকর। তাহা পড়িয়া শিহরিয়া ওঠা ছাড়া গতি নাই। অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ হইলে দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি জরুরি। কিন্তু সেই শাস্তি যথার্থ রীতিপদ্ধতি মানিয়াই হইতে হইবে, ক্ষুব্ধ জনতার গণধোলাইয়ে হইবে না— ইহা তো নাগরিক সভ্যতার গোড়ার কথা। অপরাধের ভয়ংকরতা আইনের শাসনের অসারতা প্রমাণ করে না। সভ্য সমাজে, বিশেষত গণতান্ত্রিক সমাজে, মহা দুর্বৃত্তকেও শাস্তি দিবার আইনগত পদ্ধতি থাকে। লক্ষ করিবার বিষয়, যে অভিভাবকরা সন্তানদের ভাল বিদ্যালয়ে পড়াইতেছেন, যাঁহারা নিজেরা বাড়িতে সন্তানদের নাগরিকতার শিক্ষা দিবেন এমনই প্রত্যাশা, তাঁহারা নিজেরাই পূর্ণ নৈরাজ্যে বিশ্বাসী। শিক্ষিত হইতে স্বল্পশিক্ষিত, বিত্তশালী হইতে স্বল্পবিত্ত, সর্বজনীন উদ্যোগে এখন এই হিংসার আগুন রাজ্যের গোটা অবয়ব জুড়িয়া লেলিহান জ্বলিতেছে।

এই আগুন এতখানি ছড়াইবার প্রথম দায় লইতে হইবে প্রশাসনকে। তাঁহারা নিজেরা যাহাই ভাবুন ও বলুন, সমাজের ভারসাম্য ও চরিত্র এ-ভাবে নষ্ট হইবার প্রধান কারণ, সমাজের বিবিধ পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ধ্বস্ত হওয়া। প্রশাসনের হাতে সমাজ রক্ষার ভার থাকিবার কথা। সমাজ যখন তাহা জানে না, কিংবা ভুলিয়া যায়, তাহার অর্থ এই যে, তাহাকে রক্ষা করিবার বা শাসন করিবার মতো কেহ নাই বলিয়াই এই অতিক্রমণ বা বিস্মরণ। ‘ইতিহাসের সমাপ্তি’-খ্যাত পণ্ডিত ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা তাঁহার ‘ট্রাস্ট’ নামক বইতে বলিয়াছেন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল কথা— ট্রাস্ট বা আস্থা, এবং দ্বিতীয়টির অভাবে প্রথমটির অভাব ঘটে। তাঁহার অন্যান্য ঘোষণার মতো ইহাকে বিতর্কিত বলা যায় না। ফুকুয়ামা জানেন না, পশ্চিমবঙ্গ তাঁহার তত্ত্বের উদাহরণ হিসাবে স্থান করিয়া লইতে প্রত্যহ প্রয়াসী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Indecency Social degradation civilization
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE