ইতিহাস বিষয়টির যদি প্রাণ থাকিত, তাহা এত দিনে কাঁদিয়া কাটিয়া পায়ে পড়িয়া পদার্থবিদ্যা কিংবা সংখ্যাতত্ত্ব হইতে চাহিত। প্রতি দিন তাহার এত হেনস্তা, এত অত্যাচার হইতে নিষ্কৃতি চাহিত। বিশেষ করিয়া মোদী সরকার তখ্তে বসিবার পর হইতে সে এক দিনের জন্যও বিরাম পায় নাই— আগরা হইতে মুঘলসরাই, আওরঙ্গজেব হইতে টিপু সুলতান, পদ্মিনী হইতে বিবেকানন্দ, বাবাসাহেব হইতে সর্দার পটেল, প্রতিটি যুগের প্রতিটি অধ্যায়ের মধ্যে কেবলই অশান্তি আর তর্কাতর্কি ঢুকিয়া তাহাকে একেবারে নাজেহাল করিয়া দিতেছে। কোনও ভাবে ইতিহাসকে কিছু কালের জন্য ভারতীয় ভাবনার পরিসর হইতে নির্বাসিত করা যায় কি না, বিবেচনা অত্যন্ত জরুরি। নতুবা সে আর বেশি দিন বাঁচিবে না, অচিরেই পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইবে। আপাতত টিপু সুলতানকে লইয়া দক্ষিণী রাজ্যটি যে পরিমাণ উত্তপ্ত, এবং তাহাতে ওই রাজ্যের সামগ্রিক সমাজ যে ভাবে জড়াইয়া পড়িতেছে, তাহাতে স্পষ্ট: কর্নাটকের আসন্ন ভোট না চুকিলে ইতিহাস ছুটি পাইবে না। টিপুকে লইয়া তো অশান্তি নূতন নয়। কিন্তু এ বার সেই অশান্তি যেমন ভয়ানক, তাহাতে বলা যায়, কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশটির অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক চরিত্র হওয়াতেই কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের আমলে টিপুর এই দুরবস্থা। নতুবা দশ নভেম্বর টিপু-জয়ন্তী করার কংগ্রেসি সিদ্ধান্ত ও সেই উৎসব পণ্ড করিবার বিরোধী বিজেপি সিদ্ধান্ত, কোনওটিই এত উত্তাল হইত না।
বিরোধীদের যুক্তি, টিপু সুলতান হিন্দুদের বিরুদ্ধভাবাপন্ন ছিলেন, তাহাদের উপর লুণ্ঠন-অত্যাচার করিয়াছেন, তাঁহাকে মাথায় তুলিবার দরকার কী। বিপক্ষের যুক্তিও সরলীকৃত: টিপু ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তাই তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষও ছিলেন ইত্যাদি। সত্য খুঁজিতে চাহিলে প্রথম কাজ রাজনীতির ফাঁদ হইতে বাহির হওয়া। কিন্তু এত দিনের পাঠ্য ইতিহাসেও কি এক ধরনের রাজনীতি ঢুকিয়া নাই? টিপুকে জাতীয়তাবাদী যোদ্ধা প্রতিপন্ন করিবার অকারণ প্রয়াস নাই? সরল কথাটি ইহাই: টিপু সুলতান জাতীয়তাবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ নহেন, কেননা এই শব্দগুলির সে সময়ে কোনও অস্তিত্বই ছিল না। তিনি নিজের রাজ্য বাঁচাইতে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়িয়াছিলেন, যেমন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাইও। আবার, টিপু হিন্দুদের উপর নানা অর্থনৈতিক নির্যাতন করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি হিন্দু মন্দির, শিল্প, সংস্কৃতি ও বিদ্বজ্জনের কদরও করিতেন।
একই ভাবে, গোটা কর্নাটকের কাছে টিপু তারকা বলিয়া প্রতিভাত হইতে পারেন না, কেননা কোদাগু অঞ্চলটিতে সত্যই তিনি ছিলেন বহিরাগত বাহিনীর আগ্রাসনের প্রতিভূ। কোদাগু তাঁহার সময়ই কর্নাটকের বাকি অংশের সহিত এতটা যুক্ত হয়, যাহার নিহিত অপর বাস্তবটি হইল, কোদাগুর নিজস্বতা টিপুর সময়ই অনেকাংশে লয়প্রাপ্ত হয়। এই সমস্ত আলোছায়া হইতে উদ্ধার করিয়া টিপু সুলতানের জন্মদিনটিকে যে ভাবে বিশিষ্ট ঐতিহাসিক দিবস হিসাবে পালন করিতে চাহিতেছেন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া, তাহা অবশ্যই রাজনীতি, মুসলিম ও কংগ্রেসি ভোট টানিবার মোক্ষম চাল। আবার সেই জন্মদিবস পালনের উৎসবের যে বিরুদ্ধতা চলিতেছে, তাহাও নিখাদ রাজনীতি, হিন্দুত্ববাদের ঢল তুলিয়া ভোটনদীতে বান আনিবার চেষ্টা। ইহার মধ্যে ইতিহাসের দাবি-প্রতিদাবির ভূমিকা নেহাত প্রান্তিক। কংগ্রেস ও বিজেপি, দুই পক্ষের প্রতিই ইতিহাসসচেতন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভারতবাসীর একটি প্রার্থনা: এই সব ছাড়িয়া কিছু ঘটমান বাস্তব লইয়া রাজনীতি করিলে বেচারি ইতিহাসও হাঁপ ছাড়িবে, রাজনীতিও নিজের পায়ে দাঁড়াইবে। শেষ কথা তো ভোটের হিসাব। তাহা না হয় অষ্টাদশ শতকীয় সুলতানকে ছাড়িয়া একবিংশ শতকীয় নায়ককে ঘিরিয়াই বিকশিত হউক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy