Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

একটি জীবন

ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য আকাশ হইতে পড়ে না, তাহার উৎসে থাকে ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্বের যে স্বাতন্ত্র্য ক্রমশ সমাজের চোখে উন্মোচিত হইয়াছিল, তাহার মৌলিক ধর্মটি বহুমাত্রিকতার।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২০ ০১:৩০
Share: Save:

অপূরণীয় ক্ষতি কথাটি বহুব্যবহারে জীর্ণ হইয়াছে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের বিদায়ের পরে বহুজনের মনে যে ক্ষতির উপলব্ধি ঘটে, তাহা বাস্তবিকই অপূরণীয়। সেই সব মানুষ তাঁহাদের জীবনের মধ্য দিয়া এমন সম্পদ সৃষ্টি করিয়া যান, যাহা বহুজনের অস্তিত্বকে সমৃদ্ধ করিয়া তুলে। বাহিরের নহে, সেই সমৃদ্ধি অন্তরের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তেমনই এক জন স্রষ্টা। ছয় দশক ধরিয়া বাংলা চলচ্চিত্রের পর্দায় তাঁহার উজ্জ্বল উপস্থিতি কেবল দীর্ঘ সময়ের কারণে অনন্য নহে, তাঁহার অভিনীত চরিত্রাবলির ব্যাপ্তি এবং গভীরতার মাপকাঠিতেও অসামান্য। জনপ্রিয় রোম্যান্টিক নায়ক হইতে সম্মানিত চরিত্র-অভিনেতা— তাঁহার বহুমাত্রিক স্বীকৃতির সহিত সমাজ কালক্রমে এতটাই অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল যে, এই স্বীকৃতির পূর্ণ ঐশ্বর্য হয়তো সম্যক হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই। আজ, তাঁহার বিদায়ের পরে, সমাজমানসে যে গভীর শূন্যতার বোধ তৈরি হইয়াছে, উচ্ছ্বসিত আবেগের ক্ষণস্থায়ী তরঙ্গ স্তিমিত হইবার পরে কালক্রমে তাহা প্রগাঢ়তর হইবে। তাঁহার অন্তিমযাত্রায় সংযত বেদনার যে প্রকাশ অনেককেই মুগ্ধ, শ্রদ্ধাবনত এবং কলিকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে— কিঞ্চিৎ বিস্মিত করিয়াছে, তাহার অন্তরে বোধ করি এই শূন্যতার অনুভবই আধেক লীন।

ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্য আকাশ হইতে পড়ে না, তাহার উৎসে থাকে ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তিত্বের যে স্বাতন্ত্র্য ক্রমশ সমাজের চোখে উন্মোচিত হইয়াছিল, তাহার মৌলিক ধর্মটি বহুমাত্রিকতার। তিনি কেবল চলচ্চিত্রের নায়ক ছিলেন না, মঞ্চাভিনয়ে তাঁহার কৃতি শেষ জীবন অবধি উজ্জ্বল। আবৃত্তি ও পাঠের ভুবনেও তিনি কেবল স্বকীয় নহেন, আক্ষরিক অর্থেই অ-সাধারণ। তাহার পাশাপাশি সক্রিয় ছিল নিজস্ব সৃষ্টির তাগিদ, নাটকে, কবিতায়, গদ্যে এবং শেষ জীবনে আঁকা কিছু চিত্রে তাহার স্বাক্ষর। চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান নায়ক একটি মননশীল পত্রিকার সম্পাদনার কাজে নিজেকে নিবিষ্ট রাখিয়াছেন— এমন নজির সুলভ নহে! যাহাকে সচরাচর ‘নবজাগরণের মন’ অভিধা দেওয়া হয়, তিনি সেই মনের অধিকারী ছিলেন। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে, এক দিকে তাহার অনন্ত সৃষ্টি-সম্ভাবনা এবং অন্য দিকে তাহার বিপুল অন্যায় সম্পর্কে তাঁহার চেতনা চিরকাল জাগ্রত ছিল। সামাজিক পরিসরে তাঁহার সচেতন এবং অনেক সময়েই সক্রিয় ভূমিকা এই পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সমস্ত মিলাইয়াই তিনি প্রকৃত অর্থেই নবজাগরণের মানুষ, যে মানুষ এক কালে বঙ্গসমাজের স্বাভাবিক অঙ্গ ছিল, যাহাকে আজ এই সমাজ অনেকাংশে হারাইয়াছে। সেই কারণেও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিদায় এক বড় শূন্যস্থান তৈরি করিয়া গেল।

অনন্য প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির যে স্বভাবধর্মের কথা বিশেষ করিয়া না বলিলে বড় ঘাটতি থাকিয়া যায়, তাহার নাম কর্মযোগ। অক্লান্ত শব্দটি তাঁহার জীবনে আক্ষরিক অর্থে সত্য ছিল। তিনি কর্মজীবনের শেষ দিন অবধি ক্লান্তিহীন ভাবে কাজ করিয়া গিয়াছেন। তাহার পিছনে জাগতিক দায় ছিল। কিন্তু তাহার সঙ্গে মিলিয়াছিল কাজের প্রতি এক অবিচল এবং পরিপূর্ণ নিষ্ঠা। সাধনা ইহারই নাম। সেই সাধনা কেবল শারীরিক পরিশ্রমের বিষয় নহে, তাহাতে মন এবং মস্তিষ্কের অনুশীলনও অপরিসীম। অগণন অনুরাগী তাঁহার অভিনীত যে চরিত্রগুলির মধ্য দিয়া আজ তাঁহাকে স্মরণ করিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাদের সহিত একাত্ম হইবার সাধনায় তিনি কতটা ‘কাজ’ করিয়াছিলেন, ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। সৃষ্টি-সাফল্যে ‘স্বাভাবিক প্রতিভা’কে সমাজে যে সবিস্ময় স্বীকৃতি দেওয়া হয়, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমকে সাধারণত সেই মর্যাদা দেওয়া হয় না। তাহা যে কত বড় অন্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবন তাহার এক মূল্যবান নিদর্শন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE