Advertisement
E-Paper

শপিংস্তানে সাবধান

গোপাল চায়ের কাপ নামিয়ে যায়। শিশির প্রায় এক চুমুকে কাপ শেষ করে বলল, ‘‘গোটা কলকাতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে রে একটা দোকানে। ‘বাই টু গেট টু ফ্রি’ বলেই এমন হাঘরের মতো ছুটতে হবে? ছ্যাঃ!’’

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০৯

ধুর ধুর! আহাম্মক না হলে কেউ কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে পুজোর বাজার করতে যায়?’’ চেয়ার টেনে নিয়ে ধপ করে বসে শিশির। টেবিলে পড়ে থাকা আনন্দবাজারটা তুলে হাওয়া করে নিজেকে, তার পর, ‘‘গোপাল, চা’’ বলে হাঁক দেয়।

‘‘কী হল আবার?’’ প্রশ্ন করে তপেশ।

গোপাল চায়ের কাপ নামিয়ে যায়। শিশির প্রায় এক চুমুকে কাপ শেষ করে বলল, ‘‘গোটা কলকাতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে রে একটা দোকানে। ‘বাই টু গেট টু ফ্রি’ বলেই এমন হাঘরের মতো ছুটতে হবে? ছ্যাঃ!’’

‘‘তা, তুই ছুটেছিলি কেন?’’ শিবুদা প্রশ্ন করেন।

থতমত খায় শিশির। ‘‘সে কি আর শখে? বৌ বলল। শ্বশুরবাড়ির উপহারও তো কিনতে হবে। ভাবলাম, ফ্রি দিচ্ছে যখন, সেরেই রাখি।’’

‘‘গোটা কলকাতারই তো শ্বশুরবাড়ি আছে, ভুলে যাচ্ছিস কেন?’’ মুচকি হেসে উত্তর দেয় সূর্য।

‘‘শুধু কলকাতার নয়, গোটা দুনিয়ার আছে।’’ বললেন শিবুদা। ‘‘দুনিয়ার যে প্রান্তেই একটা কিনলে একটা ফ্রি-র অফার চলে, সেখানেই মানুষ হামলে প়ড়ে। এমনই যে অর্থনীতির তত্ত্বে একটা নতুন নামই তৈরি হয়ে গিয়েছে— জ়িরো প্রাইস এফেক্ট।’’

একটা সিগারেট ধরিয়ে আলগোছে ধোঁয়া ছাড়েন শিবুদা। ‘‘দোকান-বাজার যে খতরনাক জায়গা, সে তোদের অনেক বার বলেছি। মনে রাখিসনি, সেটা তোদের সমস্যা। দোকানের বড় বিপদগুলোর একটা হল এই ফ্রি দেওয়া। ভেবে দেখ, জীবনে কত বার শুধু ফ্রি-র লোভে পড়ে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে এনেছিস বাড়িতে। ফ্রি জার-এর লোভে এক সঙ্গে তিন প্যাকেট ওটমিল কিনেছিস, ফ্রি বেডকভার পাবি বলে বেখাপ্পা পাজামা কিনেছিস অকারণে। চারটে জিনস লাগবে না জেনেও দুটো ফ্রি পাওয়ার লোভে দুটো কিনে ফেলেছিস সাত হাজার টাকা দিয়ে। তবে একটাই কথা— এই বেহদ্দ বোকামোগুলো একা তোরাই করিসনি, গোটা দুনিয়া করে চলেছে।’’

‘‘খামকাই বকাবকি করছেন’’, বলল তপেশ। ‘‘সংসারী মানুষকে এ ভাবেই বুঝে চলতে হয়।’’

‘‘এইটেই হল কথা’’, তপেশের মুখের কথা কেড়ে নেন শিবুদা। ‘‘সংসারী মানুষ মানেই তো অল্প টাকায় অনেক সাধ মেটানোর খেলায় নাজেহাল লোকজন। ঠকে যেতে কারও ভাল লাগে না, সংসারী লোকদের তো নয়ই। এ বার ভাব, যে কোনও জিনিস কেনার ক্ষেত্রেই ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, যেটা কিনছিস, সেটার দাম ঠিক কত হওয়া উচিত, বোঝার কোনও উপায় নেই তোর। কিন্তু, কোনও জিনিস কিনতে যদি পয়সাই না লাগে, তা হলে তো ঠকার কোনও জায়গাই নেই— মিনিমাগনায় যেটা পাওয়া যায়, সেটা তো পুরোটাই লাভ। আর, সেই লাভেই চোখ আটকে যায়। বিনেপয়সার উপহার পেতে যে কত টাকা খরচ হয় অকারণে, সেটা খেয়াল থাকে না।’’

‘‘ড্যান এরিলি-র কথা বলেছি আগে?’’ শিবুদা প্রশ্ন করেন। ‘‘ডিউক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। এক ছাত্রী আর এক সহকর্মীকে নিয়ে এক বার চকোলেটের ব্যবসায় নেমেছিলেন ড্যান। দু’রকমের চকোলেট রেখেছিলেন টেবিলে— লিন্ট-এর চকোলেট ট্রাফল আর হার্শি হার্ট। দুটোর মধ্যে ফারাক কতটা, কলকাতার মিষ্টি দিয়ে বলি। ধর, প্রথমটা যদি নকুড়ের নরমপাকের সন্দেশ হয়, দ্বিতীয়টা পাড়ার দোকানের গুজিয়া। দুটো চকোলেটই বেজায় শস্তায় বেচছিলেন ড্যানরা। লিন্ট-এর দাম রেখেছিলেন ১৫ সেন্ট, যার এমনিতে দাম দ্বিগুণেরও বেশি, আর হার্শির দাম এক সেন্ট। একটাই নিয়ম, এক জন খদ্দের একটাই চকোলেট কিনতে পারবে। দেখা গেল, যুক্তি যা বলে, লোকে ঠিক সেটাই করছে— ৭৩% লোক লিন্টের চকোলেট ট্রাফল কিনল, ২৭% লোক কিনল হার্শি হার্ট।

‘‘এর পর ড্যানরা চকোলেটের দাম কমালেন এক সেন্ট— লিন্টের দাম হল ১৪ সেন্ট, আর হার্শি পাওয়া গেল বিনে পয়সায়। ফ্রি। তার পরই মজা। দেখা গেল, ৬৯% খদ্দের সেই ফ্রি হার্শি নিচ্ছে, অথচ বাজারের দামের অর্ধেকেরও কম খরচে পাওয়া যাচ্ছে যে লিন্টের ট্রাফল, সেটা কিনছে মাত্র ৩১% লোক। এত ক্ষণের কাণ্ডজ্ঞান, সংসারী লোকের বুদ্ধি, বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল ফ্রি-র গন্ধ পেতেই। ভেবে দেখ, পাঁচ টাকায় নকুড়ের সন্দেশ পাওয়া যাচ্ছে, অথচ লোকে ছুটছে বিনেপয়সার গুজিয়া খেতে! কাণ্ডজ্ঞান গুলিয়ে না গেলে কেউ করে?’’

‘‘তা হলে বলছেন, ফ্রি দেখলেই সন্দেহ করব, সাড়ে পাঁচ ফুটের কম হাইটের বাঙালির মতো?’’ প্রশ্ন করে তপেশ।

‘‘ঠিক তা নয়’’, উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘এই যে ধর আমি ফ্রিতে জ্ঞান দিচ্ছি, এটা নিলে ক্ষতি নেই। কিন্তু, যেখানে একটা বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের জায়গা থাকে— মানে, ফ্রি-তে পাওয়া জিনিসের সঙ্গে পয়সা দিয়ে কিনতে হওয়া জিনিসের মধ্যে একটাকে বেছে নেওয়ার প্রশ্ন থাকে— গোলমালটা সেখানে। প্রায় ক্ষেত্রেই ফ্রি-র লোভে মানুষ ভুল সিদ্ধান্ত করে।

‘‘গোলমালের আর একটা মোক্ষম জায়গা কোথায়, জানিস? চেক আউট কাউন্টারে। ধর, পুরো সময়টা তুই লোভ সামলে যেটুকু প্রয়োজন, সেটুকুই কিনে কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ালি। ক্যাশিয়ার মেয়েটা তোর বিল যোগ করে জানাল, ‘স্যর, আপনার ২৭৯০ টাকা হয়েছে, আর স্টোরে অফার চলছে, ৩০০০ টাকার কেনাকাটা করলে একটা বেডকভার ফ্রি’। বেশির ভাগ লোক যেটা করে, তুইও নির্ঘাত সেটাই করবি। দেখবি, কাউন্টারের ধারেকাছে এমন কী জিনিস আছে, যেটার দাম মোটামুটি ২১০ টাকা। হিসেব করবি, বেডকভারের দাম তো চারশো সাড়ে চারশোর কম হবে না— মানে, আড়াইশো টাকা কমেই হল। দোকানের লোকরাও জানে এই কথাটা। হাতের কাছে সাজিয়েই রাখে হরেক অবান্তর জিনিস, যা তুই এমনিতে কিনতিস না মোটেও।’’

‘‘এ বার আমি আপনাকে একটা উদাহরণ দিই’’, সূর্য বলল। ‘‘আমাজ়ন, ফ্লিপকার্টে ৫০০ টাকার কেনাকাটা করলে শিপিং ফ্রি, নয়তো গোটা পঞ্চাশেক টাকা খরচ হয় তাতে। কত বার যে ফ্রি শিপিংয়ের লোভে অপ্রয়োজনে একটা বাড়তি জিনিস কিনেছি, ভাবতেও পারবেন না।’’

‘‘বিলক্ষণ ভাবতে পারব’’, উত্তর দেন শিবুদা। ‘‘আমাজ়নেরই গল্প বলি, শোন। আমাজ়ন যখন নির্দিষ্ট মূল্যের বেশি টাকার কেনাকাটার ওপর প্রথম ফ্রি শিপিং আরম্ভ করল, গোটা দুনিয়াতেই আমাজ়নের বিক্রি বেড়েছিল বিপুল পরিমাণে। বাড়েনি শুধু ফ্রান্সে। যথারীতি খোঁজ পড়ল— ফ্রান্সের খদ্দেরদের কি তবে কাণ্ডজ্ঞান এত বেশি যে গোটা দুনিয়া যে ফ্রি শিপিংয়ের মোহে পড়ল, ফরাসিরা সেটাকে নিয়ে মাথাই ঘামাল না? তার পর দেখা গেল, আমাজ়নের ফ্রান্সের কর্তারা নিয়মটা একটু পাল্টেছেন। শিপিং সম্পূর্ণ ফ্রি করেননি, তার জন্য মাত্র এক ফ্রাঙ্ক নিচ্ছেন। অতি সামান্য টাকা। তড়িঘড়ি নিয়ম পাল্টাল, ফ্রান্সেও শিপিং ফ্রি হল। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্রান্সের ক্রেতারাও নাম লেখাল গোটা দুনিয়ার দলে। যত টাকার জিনিস কিনলে ফ্রি শিপিং পাওয়া যায়, গড় কেনাকাটার অঙ্ক ছাপিয়ে গেল তাকে। অতএব বাছাধন, ফ্রি-র চক্করে প়ড়েছ কি মরেছ। গাঁটগচ্চা যাবেই।’’

এত ক্ষণে গোপাল ফের এক কাপ চা দিয়ে যায়। শিবুদা আয়েশ করে চুমুক দেন। একটা সিগারেট ধরান। তার পর প্রশ্ন করেন, ‘‘নগদে কেনাকাটা করলি, শিশির?’’

‘‘এখন অত ক্যাশ কেউ ক্যারি করে?’’ পাল্টা প্রশ্ন করে শিশির।

‘‘হুম, ডিজিটাল ইন্ডিয়া!’’ একপেশে হাসিটা হাসেন শিবুদা। ‘‘ক্রেডিট কার্ডে প্রতিটা লেনদেনের জন্য দোকানগুলোকে কতগুলো করে টাকা দিতে হয় ব্যাঙ্ককে, জানিস? বল দিকি, তবু কেন দোকানগুলো ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট নেয়? কেন তোর থেকে সেই ট্রানজ়াকশন ফি দাবি করে না?’’

‘‘কার্ডে না নিলে অর্ধেক লোক কিনবেই না।’’ উত্তর দেয় তপেশ। ‘‘পকেটে টাকা নেই, অথচ শপিং করতে ইচ্ছে করছে, এই অবস্থায় ক্রেডিট কার্ডই মধ্যবিত্তের ভরসা, শিবুদা।’’

‘‘অর্ধেকটা ঠিক বললি’’, বললেন শিবুদা। ‘‘অর্ধেকও নয় আসলে, ওয়ান-থার্ড। দ্বিতীয় কারণটা হল— বিহেভিয়ারাল ইকনমিকস যাকে বলবে— ফাজ ফ্যাক্টর। নগদ খরচ করতে আমরা যতখানি ইতস্তত করি, ক্রেডিট কার্ডে খরচ করতে ততখানি নয়। কারণ, তক্ষুনি নগদ মিটিয়ে দেওয়ার চাপ না থাকাটা আমাদের অবচেতনেই এই কেনাকাটার সঙ্গে টাকা খরচ— অতএব, এক ধরনের লোকসানের— একটা দূরত্ব তৈরি করে দেয়। ড্যান এরিলির কথা বলছিলাম না একটু আগে, ওঁর একটা চমৎকার বই আছে। দি অনেস্ট থিং অ্যাবাউট ডিজ়অনেস্টি।

‘‘কিন্তু, তার চেয়েও বড় কারণটা খুঁজে বার করেছিলেন এক সাইকলজিস্ট আর দুই ইকনমিস্ট। রিচার্ড ফাইনবার্গ আর ড্রেজ়েন প্রেলেক ও ডানকান সিমেস্টার। অকাট্য প্রমাণ পেশ করে দেখিয়েছিলেন, নগদের বদলে ক্রেডিট কার্ডে টাকা মেটালে মানুষ বেশি খরচ করে। যে কোনও জিনিসের জন্যই বেশি দাম দিতে রাজি হয়ে যায়। একটু-আধটু বেশি নয়, প্রায় দেড় গুণ। সচেতন ভাবে না জেনেই করে। ভারত ডিজিটাল হলে কাদের লাভ, ভেবে দেখিস।’’

Greed Shopping Mall Sale
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy