Advertisement
E-Paper

পাহাড়ের রাজনীতি বুঝতে অর্থনীতির খোঁজ নিতে হবে

১৯৮০-র দশকে পাহাড়ে নির্বিচারে অরণ্যচ্ছেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার আগে অবধি গাছ কেটে প্রচুর ধুপিচাষ হয়েছে। এই চাষের জন্য শ্রমিক আসত স্থানীয় গ্রাম থেকে।

জেতা সাংকৃত্যায়ন

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৭ ১৪:০৩

অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে রাজনীতির গল্পটা বোঝা কার্যত অসম্ভব। দার্জিলিঙের রাজনীতি বুঝতেও, অতএব, পাহাড়ের অর্থনীতিটাকে বোঝা দরকার। এখন পাহাড়ের মোট জমির এক-তৃতীয়াংশে রয়েছে প্রাকৃতিক অরণ্য। আরও এক-তৃতীয়াংশ জমিতে চা এবং সিঙ্কোনা চাষ হয়। এই জমিও প্রাকৃতিক অরণ্য ছিল। শ’দেড়েক বছর আগে, মূলত তিস্তার পশ্চিমে দার্জিলিং ও কার্সিয়ং সাবডিভিশনে জঙ্গল কেটে চা আর সিঙ্কোনা চাষ আরম্ভ হয়। পাহাড়ের কৃষিজমির প্রায় সবটাই রয়েছে কালিম্পং জেলায়, তিস্তার পুব পাড়ে। এখানে মাত্র তিনটি চা বাগান তৈরি হয়েছিল। সোনাদা, বিজনবাড়ি, তাকদায় জঙ্গল আর চা বাগানের মধ্যে ছবির মতো চাষের খেত রয়েছে। পাহাড়ের মোট জমির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ কৃষিতে রয়েছে। অর্থাৎ, এই এক-তৃতীয়াংশ জমিই পাহাড়ের মানুষের হাতে। বাকিটা হয় সরকারের অধীনে থাকা জঙ্গল, অথবা দীর্ঘমেয়াদি লিজে দেওয়া চা-বাগান। পাহাড়ে জমির এই বণ্টন গ্রামীণ কর্মসংস্থানের পথে মস্ত বাধা।

১৯৮০-র দশকে পাহাড়ে নির্বিচারে অরণ্যচ্ছেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার আগে অবধি গাছ কেটে প্রচুর ধুপিচাষ হয়েছে। এই চাষের জন্য শ্রমিক আসত স্থানীয় গ্রাম থেকে। ধুপিচাষ বন্ধ হওয়ার পর তাঁদের জীবিকাও খোয়া গেছে। আয় প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছে। চাষের জন্য তাঁরা যে জমি পেয়েছেন, তা বন দফতরের। সমস্যা হল, সেই জমিতে চাষ করতে গেলে নিয়মিত বন্য প্রাণীর উপদ্রবও সহ্য করতে হয়। তা ছাড়াও, কৃষিজাত পণ্য বাজারে পৌঁছে দেওয়া এতই কঠিন যে পাহাড়ের গ্রামে কৃষি কখনও যথেষ্ট লাভজনক হতে পারেনি।

পাহাড়ের গায়ে যাঁরা ধাপচাষ করেন, তাঁদেরও লড়াই কঠিন। এক দিকে অর্থনৈতিক বাধা, অন্য দিকে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা। পাহাড়ে আবহাওয়ার কারণেই চাষের মরশুম সীমিত। সেচও নেই বললেই চলে। ফলে, বছরে একটার বেশি ফসল ফলানো যায় না, সেই চাষও উৎপাদনশীল নয়। আরও সমস্যা, নিজেদের খিদে মিটিয়ে সেই ফসলের যতটুকু বাঁচে, তাকে বাজারে পৌঁছে দেওয়া খুব কঠিন। বেঁচে থাকার তাগিদে পাহাড়ের কৃষিজীবীরা ক্রমেই আলু, আদা আর কমলার চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। এই ফসল থেকে যেটুকু টাকা পাওয়া যায়, তাতেই গোটা বছরের সংস্থান করতে হয়। শীতকালে এমনই ঠান্ডা যে রবি ফসল ফলানোর কোনও উপায় নেই।

গত দেড়শো বছরেরও বেশি সময় দার্জিলিং-এর পাহাড়ে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছে চা বাগানে। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের কল্যাণে পাহাড়ের চা শিল্পের দ্রুত বৃদ্ধি হয়েছিল। পাশাপাশি আবাসিক স্কুলগুলোরও রমরমা হয়েছিল, বেড়েছিল পর্যটনের সুযোগও। এই রেলওয়ে কখনও ‘টয়-ট্রেন’ ছিল না, ছিল পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের যোগাযোগরক্ষার খুব জরুরি একটা মাধ্যম। পাহাড় থেকে নীচে চা পৌঁছে দেওয়া, আর সমতল থেকে বিবিধ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাহাড়ে নিয়ে আসা, এই কাজটা করত এই ট্রেন। যাতায়াতের খরচও কমেছিল, এবং তার ফলেই কার্সিয়াং আর দার্জিলিং দুটো গুরুত্বপূর্ণ পার্বত্য শহর হয়ে উঠতে পেরেছিল।

আজ এই দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে কার্যত অচল। ট্যুরিস্টদের জন্য একটা ছোট পথে এই ট্রেন চালানো হয়, কিন্তু সেই অবধিই। ১৯৭০-এর দশকে এই রেলওয়েতে পণ্য পরিবহণ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে পাহাড়ের অর্থনীতির শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েছিল। এর ফলে দার্জিলিং সস্তার জায়গা থেকে তুমুল খরচের জায়গায় পরিণত হল। এমন একটা জায়গা, যেখানে মানুষের রোজগার সামান্য, কিন্তু প্রতিটি পণ্যের দাম বেশি।

চা বাগানগুলি এককালে বিপুল লাভজনক ছিল। মালিকপক্ষ প্রচুর আয় করেছেন। কিন্তু, সেই বাগানের শ্রমিকরা চার প্রজন্ম ধরে এটুকুও আয় করতে পারেননি যাতে তাঁরা নিজেদের জন্য একটা বাড়ি বানাতে পারেন, বা কিছু কিনতে পারেন। পরিবারের এক জন কাজ করেন, এবং তাঁর আয়েই সংসার চলে— এই নিয়ম চা বাগানের জন্য নয়। এখানে প্রথাগত ভাবেই গোটা পরিবারের শ্রমের ওপর মজুরির পরিমাণ নির্ধারিত হয়। চা পাতা তোলার কাজটা করেন মহিলারাই— যত পাতা তুলতে পারেন, তার ভিত্তিতে দিনের মজুরি নির্ধারিত হয়। সেই চা বাজারে বিপুল মূল্যে বিক্রি হয় বটে, কিন্তু বাগানের মহিলা শ্রমিকদের মজুরিতে সেই দামের কোনও প্রতিফলন কখনও ঘটেনি। দক্ষিণ ভারতের চা বাগানগুলোর সঙ্গে দার্জিলিঙের ফারাক আছে। সেখানে সারা বছরই চা পাতা তোলার কাজ চলে। দার্জিলিঙে কাজ হয় আট থেকে ন’মাস। বাকি তিন-চার মাস বেঁচে থাকতে হয় সেই টাকার ভরসাতেই।

একটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠিত ক্ষেত্র হিসেবে চা বাগানও ১৯৪৮ সালের ন্যূনতম মজুরি আইনের অন্তর্গত হয়েছিল। কিন্তু, বাগানে সেই আইন কখনও প্রয়োগ করা হয়নি। অজুহাত ছিল, ১৯৫১ সালের প্ল্যান্টেশন লেবার অ্যাক্ট-এর অধীনে চা-শ্রমিকরা মজুরির অতিরিক্ত সুযোগসুবিধা পেয়েই থাকেন। কিন্তু, বাস্তব অন্য রকম। বিপিএল তালিকাভুক্ত মানুষের জন্য যে রেশন আসে, তাকেও গণ্য করা হয় এই মজুরি-বহির্ভূত সুবিধার তালিকায়। চা বাগানের হাসপাতালগুলোয় প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও মেলে না। আগে রান্নার জন্য জ্বালানি কাঠ দেওয়া হত। বন বিভাগ তার জোগান দিতে না পারায় এখন নগদ টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু, চা-শ্রমিকের রান্নাঘরে এখনও কাঠের চুলোই জ্বলে।

চা বাগানের শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু বেশ কিছু দশক ধরে পাকা শ্রমিক নিয়োগ বন্ধ। তার বদলে ঠিকা শ্রমিক দিয়ে কাজ চলছে। তাঁদের জন্য এই সামান্য ব্যবস্থাগুলো করারও দায় নেই। চায়ের উৎপাদন বেড়েছে, উৎপাদনশীলতাও বেড়েছে। তার পিছনে রয়েছেন এই অদৃশ্য ঠিকা শ্রমিকরা।

একটা পরিবর্তন অবশ্য হয়েছে। চা-শ্রমিকরা ক্রমে টের পেয়েছেন, বাগানে ভবিষ্যৎ নেই। বাঁচতে গেলে শিক্ষাই একমাত্র পথ। ডুয়ার্সে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে চা শ্রমিকদের ভাষাগত এবং জাতিগত ফারাক থাকায় সেখানে চলে যাওয়ার সমস্যা আছে। দার্জিলিঙের পাহাড়ে সে ঝামেলা নেই। ফলে, চা-শ্রমিক পরিবারের তরুণ প্রজন্ম লেখাপড়া শিখে ক্রমেই শহরমুখো হচ্ছে। পাহাড়ের শহরে অর্থনীতি মূলত পর্যটন-কেন্দ্রিক। এই শিল্প চলে মূলত বেসরকারি পুঁজির ওপর ভর করে। কিন্তু, আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে যেমন হস্তশিল্প ইত্যাদির বড় বাজার তৈরি হয়, দার্জিলিঙে তেমনটা ঘটেনি। ফলে, দার্জিলিঙের পর্যটন মূলত হোটেল ব্যবসায়ী আর গাড়ির ব্যবসায়ীদের জন্যই লাভজনক। প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান বাদে স্থানীয় অর্থনীতিতে এর খুব বেশি লাভ পৌঁছোয় না। কিন্তু, চাপ পড়ে। প্রকৃতি যতখানি সহ্য করতে পারে, দার্জিলিঙে পর্যটন শিল্প বেড়েছে তার ঢের বেশি। ফলে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, চাপ পড়ছে জল সরবরাহের ওপর। বাড়িভাড়া বেড়েছে, ভাড়া পাওয়ার মতো বাড়ির সংখ্যা কমেছে, জল পাওয়া কঠিন হয়েছে— সব মিলিয়ে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমেই আরও নিম্নমুখী হয়েছে।

পাহাড়ের রাজনীতির শিকড় অর্থনীতির এই গল্পগুলোর গভীরে। যত দিন না এই সমস্যাগুলোর দীর্ঘমেয়াদি ও সুস্থায়ী সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে, তত দিন রাজনৈতিক অশান্তি ফিরে ফিরে আসবেই।

উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

economy Politics Darjeeling Tea Estate দার্জিলিং
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy