Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Language

ভাষা হয়ে ওঠে ক্ষমতার হাতিয়ার

নিজের ভাষাকে ভালবাসব, প্রাণ দিয়ে আগলাব, আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাব— অত্যন্ত উচিত কাজ। কিন্তু যে তা করতে অপারগ তাকে শাস্তি দেব, এ কেমন কথা?

লড়াই যে হেতু আরও ক্ষমতাবান এক ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে, তাই এই জঙ্গি স্টাইল একটু বেশিই অসুবিধেজনক।

লড়াই যে হেতু আরও ক্ষমতাবান এক ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে, তাই এই জঙ্গি স্টাইল একটু বেশিই অসুবিধেজনক।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

মরাঠি ভাষার প্রচার-প্রসারে সম্প্রতি উদ্যোগী হয়েছে মহারাষ্ট্র সরকার। রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মরাঠিতে বাক্যালাপ বাধ্যতামূলক, বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্টে তার হিসেব থাকবে, হিসেব না মিললে বেতন বৃদ্ধি আটকে যাবে। কেন এত তোড়জোড়? আঞ্চলিক সরকারি ভাষাকে জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যে রাজ্য প্রশাসনেরই দায়িত্ব।

আমরা জানি, ১৯৫৬ সালে ভাষার ভিত্তিতেই তৈরি হয় রাজ্য পুনর্গঠন আইন। যে ভাষা যে অঞ্চলে বেশি চলে, তার ভিত্তিতেই নতুন প্রদেশ, সেটাই তার সরকারি ভাষা। তাকে তুলে ধরা রাষ্ট্রীয় কর্তব্যও বটে। বহিরাগত ভাষার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখাও। এ ক্ষেত্রে দুটো যুক্তি খুব জরুরি। এক, কোনও অঞ্চলে থাকতে গেলে সেখানকার স্থানীয় ভাষা শিখে নেওয়া বিধেয়। বিশেষত যাঁরা গণপরিষেবার সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা যদি অন্তত কাজ চালানোর মতো ভাষাটা না জানেন, তা হলে পরিষেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা। দুই, ‘এক দেশ এক ভাষা’ নামক জাতীয়তাবাদী ধুয়োয় হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই হয়ে আসছে। বৈশ্বিক ভাবে ইংরেজির চাপ তো আছেই। নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষা টিকিয়ে রাখতে তাই কয়েক পা বেশিই হাঁটতে হয়। সবই ঠিক ছিল, গোলমাল হয়ে গেল দণ্ড বিধানের নিদানে এসে।

এই গা-জোয়ারির ঐতিহ্য অবশ্য বহু পুরনো। গত বছর তামিলনাড়ুর তিরুচিরাপল্লি শহরের নানা সরকারি জায়গায়— বিমানবন্দর, পোস্ট অফিস, বিএসএনএল কার্যালয়— হিন্দি সাইনবোর্ডের ওপর কালি লেপে দেওয়া হয়েছিল। বেঙ্গালুরু পুরসভা জানিয়েছিল যে কোনও দোকানের ডিসপ্লে বোর্ডে কন্নড় ভাষা ‘ঠিকমতো’ দেখা না গেলে তার লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। উগ্র বাংলাবাদীদের হাতে অবাঙালিদের হয়রানির কথাও বলতে হয়। নিজের ভাষাকে ভালবাসব, প্রাণ দিয়ে আগলাব, আক্রমণের হাত থেকে বাঁচাব— অত্যন্ত উচিত কাজ। কিন্তু যে তা করতে অপারগ তাকে শাস্তি দেব, এ কেমন কথা?

লড়াই যে হেতু আরও ক্ষমতাবান এক ভাষার আধিপত্যের বিরুদ্ধে, তাই এই জঙ্গি স্টাইল একটু বেশিই অসুবিধেজনক। মনে রাখা ভাল, একটা নির্দিষ্ট ভাষার দাদাগিরি ঠেকানো প্রাথমিক লক্ষ্য, কিন্তু কেবল সেই লক্ষ্যে এগোলে লড়াইটা সঙ্কীর্ণ ও পথভ্রষ্ট হয়। আসল সংগ্রাম আধিপত্যবাদ এবং সংখ্যাগুরুর দম্ভের বিরুদ্ধে। সেটা করতে গিয়ে যদি তাদের পথেই হাঁটি, তা হলে আমরা লড়াই শুরুর আগেই হেরে গিয়েছি। কেবল হিন্দি ঠেকানোটাই কাজ নয়, আসল দায়িত্ব তার জোর-জবরদস্তির দর্শনের বিরুদ্ধে পাল্টা আখ্যান তৈরি করা। একে অপরের আয়না হয়ে ওঠার চেষ্টা করলে আঞ্চলিক ভাষাগুলির পতনই ত্বরান্বিত হবে। হিন্দির অস্ত্রে হিন্দি ঘায়েল হবে না, ভারতের আত্মার ক্ষতি হবে।

ভারত চিরকালই নানা ভাষার দেশ। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় জাতীয় প্রতীক হিসেবে এক ভাষার প্রয়োজন হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে সেই রাজনৈতিক প্রশ্নকে প্রশাসনিক পরিসরেও এনে ফেলা হয়। কিন্তু ভারতে বহু ভাষা, বহু-সংস্কৃতিই চিরকাল উদ্‌যাপিত হয়েছে। স্বভাবত বহুভাষী ভারতীয় জনতার বুলিতে ছন্দপতন ঘটেনি। গাঁধী-নেহরু-পটেলদের রাজ্য পুনর্গঠন ভাবনাও সেই ছন্দে বয়েছিল। প্রথমে ভারতকে সংযুক্ত করা, তার পর স্বাধীন সংস্কৃতির সঙ্ঘ হিসেবে তার সমৃদ্ধি। তাতেই আরও সম্পদশালী হয়েছে ভারতের ভাষা-ভান্ডার। মানুষ জন্মগত ভাবে মাতৃভাষা শেখেন, এবং শিক্ষা বা কাজের প্রয়োজনে গ্রহণ করেন হিন্দি, ইংরেজি, অন্য আঞ্চলিক সরকারি ভাষা। সংবিধানের অষ্টম তফসিলে স্বীকৃতি পেয়েছে ২২টি ভাষা, কোনও একটা রাষ্ট্রভাষা নয়। ভারত এমন এক অনুপম দেশ, যার জাতীয় প্রতীক কোনও ভাষা নয়, বহুভাষিকতা।

এই স্বচ্ছন্দ চলার বেগে হিন্দি যে শিকল পরাতে চায়, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। গত বছর হিন্দি দিবসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছিলেন, ভারতভূমির সবচেয়ে বড় সম্পদ বহুভাষা হলেও তাকে বিদেশি ভাষার আক্রমণ থেকে বাঁচাতে বাধ্য হয়েই কখনও এক ভাষার শরণাপন্ন হতে হয়। ভারতীয় বহুভাষিকতাকে তাঁরা এ ভাবেই হিন্দির ছত্রচ্ছায়ায় এনে ফেলতে তৎপর। সাম্প্রতিক শিক্ষানীতিতেও সেই ভাবনার ছাপ স্পষ্ট বলেই মনে হচ্ছে। মুখে অস্বীকার করলেও, তার রূপ দেখে ছলে-বলে-কৌশলে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার আশঙ্কাই দৃঢ় হয়। কিন্তু তার পাল্টা কখনও শিবসেনার রাজনীতি হতে পারে না, যা মরাঠি জাতি ও ভাষাকে তুলে ধরতে অ-মরাঠি বিরোধী ভাবাবেগে হাওয়া দিতে থাকে। এই রাজনীতি আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের কথা বলে, ভাষাকে এক জাতি-এক সংস্কৃতির বাহন হিসেবে কাজে লাগায়। খেয়াল করিয়ে দিই, মরাঠি গুজরাতি-তামিল-হিন্দির বিরুদ্ধে, কন্নড় তামিল-হিন্দি-মরাঠির বিরুদ্ধে, তামিল হিন্দির বিরুদ্ধে, তেলুগু ওড়িয়ার বিরুদ্ধে ক্রমাগত লড়তে থাকলে শেষাবধি ভারত নামক এই বহুত্বের আধারটাই টুকরো হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। ভারত এক ভাষার ভূমি নয়, আলাদা আলাদা কিছু দ্বীপের সমষ্টিও নয়। এর গতিশীল ভাষাচর্যায় বিচ্ছিন্ন কতকগুলো ভাষা পাশাপাশি সাজানো নেই, সংলগ্ন হয়ে উদ্‌যাপন করা আছে।

সভ্যতা সংক্রান্ত একটা প্রাথমিক শর্তের কথা শেষে বলি। কোনও মানুষ যেটা জানেন না বা পারেন না, সেই বিষয়টা তাঁর ওপর ঘাড় ধরে চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ, তাকে বৈষম্যের হাতিয়ার করে তোলা। পশ্চিমবঙ্গের কোনও সাঁওতালি বা রাজবংশীভাষী মানুষ যখন বাংলা না জানার জন্য বঞ্চিত হন, বাংলা তখন ক্ষমতার অস্ত্র হয়ে ওঠে। অহিন্দিভাষীদের ক্ষেত্রে যেমন হিন্দি জোরজুুলুম। জেনে রাখা দরকার, কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারি ভাষার বাইরেও ভারতে আরও অজস্র ভাষা আছে, যা বহু মানুষের মাতৃভাষা, দৈনন্দিন কথাবার্তায় জীবিত। সংবিধানে সেগুলিকে ‘গণতন্ত্র’-এর ভাষা বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, সে ভাষায় যে কোনও মানুষ আবেদন করতে পারেন। ক্ষমতার আস্ফালনে সেই গণতন্ত্রই দুর্বল হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Language Democracy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE