Advertisement
E-Paper

কুকুর, বেড়াল ও আমরা

কেউ জানতে চাননি, মৌটুসি বলে যে ছাত্রীটি তাঁর গ্রামের বাড়ির পোষা কুকুরটাকে এত ভালবাসেন, হঠাৎ করে তিনি এই কুকুর-নিধন যজ্ঞে খলনায়িকার ভূমিকায় এলেন কেন। কারও মনে প্রশ্ন আসেনি, কুকুরের মৃত্যুর থেকেও যেটা বেশি জরুরি বলে মনে হয়, মানুষের হাসপাতালে এত কুকুর কোন আক্কেলে ঘুরে বেড়ায় দিনভর।

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৮ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
— প্রতীকী ছবি।

— প্রতীকী ছবি।

১৬টি কুকুরছানাকে পিটিয়ে মারার অভিযোগে এনআরএস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ফোন করেছেন কেন্দ্রীয় নারী ও শিশু উন্নয়নমন্ত্রী, বিখ্যাত পশুপ্রেমী মেনকা গাঁধী। বলেছেন, ধৃতরা হয়তো জামিন হয়ে যাবে, কিন্তু হাসপাতাল যেন কড়া ব্যবস্থা করে। এই লেখাটি লেখার সময় হাসপাতালের তদন্ত কমিটি হয়তো চূড়ান্ত রিপোর্ট তৈরি করছে। নার্সিং পড়ুয়া মৌটুসি মণ্ডল ও সোমা বর্মণের ভাগ্য আপাতত সেই রিপোর্টের উপরেই ঝুলে রয়েছে।

ধৃতদের পরিচয় প্রকাশ করার দাবিতে প্রচুর পশুপ্রেমী তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। পথ অবরোধ করেছেন। এক জন প্রতিবাদীর মুখেও এই প্রশ্নটা শোনা যায়নি, এনআরএসের নার্সিং হস্টেলের চত্বরে এত কুকুর কেন। কেউ জানতে চাননি, মৌটুসি বলে যে ছাত্রীটি তাঁর গ্রামের বাড়ির পোষা কুকুরটাকে এত ভালবাসেন, হঠাৎ করে তিনি এই কুকুর-নিধন যজ্ঞে খলনায়িকার ভূমিকায় এলেন কেন। কারও মনে প্রশ্ন আসেনি, কুকুরের মৃত্যুর থেকেও যেটা বেশি জরুরি বলে মনে হয়, মানুষের হাসপাতালে এত কুকুর কোন আক্কেলে ঘুরে বেড়ায় দিনভর। বিরানব্বই-তিরানব্বই সাল নাগাদ নচিকেতা চক্রবর্তীর ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা’ গানের একটি লাইন নিয়ে তুমুল শোরগোল হয়েছিল। লাইনটি ছিল, ‘হাসপাতালের বেডে টিবি রোগীর সাথে খেলা করে শুয়োরের বাচ্চা।’ দশক আসে, দশক যায়। কাস্তে হাতুড়ির বদলে ‘ব’ লেখা বড় বল শোভা পায়। পরিস্থিতি বদলায় না। আইডি হাসপাতালের করিডরে বরাহ নন্দন না থাকলেও আজও অবাধে চক্কর মারে বেড়াল (‘হুঁশ ফেরে না হাসপাতালের’, আবাপ, ১৬-১)। সুপার মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের ক্যান্টিনে রান্নাঘরে ওত পেতে থাকে কুকুর। এনআরএসের প্রসূতি বিভাগে রোগীর বেডের পাশে রাজ করে বিড়ালের দল।

একটা পরিস্থিতির কথা ভাবি। ধরা যাক, আমার আপনার বাড়িরই কোনও মা-হতে-চলা মহিলাকে ভর্তি করানো হল এমন হাসপাতালের এমনই এক শয্যায়। অথবা ধরি, পরিচিত কোনও আত্মীয়, সদ্য অপারেশন টেবিল থেকে বার করে ঠাঁই পেয়েছেন এমনই কোনও বেডে যেখানে রোগীর সঙ্গে বিড়াল-কুকুরের সহাবস্থান। বলতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তব যে ডাক্তারবাবুদের থেকে রাউন্ডে এদেরই আনাগোনা বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ‘এ কালুয়া, ভাগ’ কিংবা ‘ও যা যা বেহায়া মেনি যা না, অন্য কোথা যা না’ বলার মতো মানসিক স্থিতি আমাদের সবার মনে আছে কি না, তা ভাবাটা জরুরি। যদি একটি কুকুরকে চার বার তাড়ানোর পরেও পঞ্চম বার আসে, তখন যদি তার মাথায় হাত না বুলিয়ে বিরক্ত হয়ে তার গায়ে আমি সজোরে একটা লাথি কষাই, লাথিটা যদি বেকায়দায় লেগে গিয়ে কুকুরটি কুঁকড়ে যায়, তা হলে আইনের চোখে আমি অপরাধী। ১৯৬০ সালের প্রিভেনশন অব ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস অ্যাক্ট আমায় খুঁজে বেড়াবে। কিন্তু সদ্যোজাত সন্তানের গা যদি চেটে দিয়ে যায় বেড়াল (বেড়ালছানা বললে শুনতে আরও মিষ্টি লাগে), কার অকর্মণ্যতায় অবোলা প্রাণীটি তা চাটল, তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা হয় না। এটাই নিয়ম, এটাই রেওয়াজ। শহরের একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এক কর্তা তো জানিয়েই দিয়েছেন, ওয়ার্ডের ভিতরে বেড়ালের উপদ্রব কমানোর জন্য বিভিন্ন দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কী করণীয়, তার কোনও উত্তর না পেয়ে তিনি হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

এ বারে একটা সহজ প্রশ্ন, বোকার মতো। এনআরএসের নার্সিং হস্টেলের ছাত্রীদের বক্তব্য, কুকুরের বাচ্চাগুলো তাঁদের পা জড়িয়ে ধরত। কামড়াত। তাঁরা ঠিকঠাক চলাফেরা করতে পারতেন না। সুপারকে লিখিত অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও তাতে কোনও কাজ হয়নি। কামড়ে থাকলে কুকুরের দাঁতের দাগের প্রমাণ তাঁরা সযত্নে শরীরে লালন করে রেখেছেন কি না জানি না। হস্টেলের ভিতরে কোনও সিসি ক্যামেরাও নেই। ফলে কামড়ানোর ফুটেজ পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই আপাতত। তাঁদের মনের মধ্যে যে ফুটেজগুলি আছে, তা হল বিরক্তির, অনন্যোপায়ের। তদন্তকারীরা একে কতটা মূল্য দেবেন তা সময় বলবে।

পশুদের আমি কোনও ক্ষতি করব না। কিন্তু পশুপ্রেম আমার কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে না। রাত সাড়ে দশটা-এগারোটায় বাড়ি ফিরি যখন, তখন পিছন থেকে হঠাৎ তিন-চারটে বখাটে কুকুর আমায় তাড়া করলে আমার মেনকা গাঁধীর কথা মনে হয় না। নিজেকে বাঁচানোর কথা মনে হয়। ছুটতে হয়। হঠাৎ যদি একটা কুকুর আমায় কামড়ে দেয় কোনও দিন, আমার কী করা উচিত তা নিয়ে এখন একটা বাহাত্তর পয়েন্টের একটা প্রশ্নচিহ্ন রয়ে গেল। আমার অফিস অফিসপাড়ায়। পাশেই তিন-চারটে বেসরকারি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ। বছর পঁচিশ-ছাব্বিশের এক যুবতীকে দেখি, দোকান থেকে রোজ দশ টাকার বিস্কুটের প্যাকেট কিনে রাস্তার কুকুরদের মধ্যে বিলি করেন, সকাল সাড়ে ন’টায়। আনন্দে কুকুরগুলোর লেজ নড়ে মশার ডানার মতো। এমন সময়ই প্রতি দিন চলে আসে লাগোয়া ঝুপড়ি থেকে এক বেআক্কেলে তিন-চার বছরের মেয়ে। খালি গায়ে। টপ কিংবা কুর্তি টেনে বলে, ও দিদি ও দিদি, একটা বিস্কুট দাও না।

দিদি বলেন, ভাগ।

• ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

Puppy Killing NRS Medical College and Hospital Student
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy