Advertisement
১০ মে ২০২৪

চাপ ছিল, ছিল না ইঁদুর-দৌড়ের দমহারা অবস্থা

সারাদিন ঘাড় গুঁজে পড়ছে সন্তান। দৌড়চ্ছে এক কোচিং সেন্টার থেকে আর একটায়। রাস্তাতেই রোল খেয়ে নেওয়া!  কচি মুখগুলোয় হাসির মধ্যেও জড়িয়ে থাকে ক্লান্তি। লিখছেন গোপা কুণ্ডুসে সময়ে এত চাপ ছিল না? কে বলেছে ছিল না! এখন তো নম্বর তোলা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে।

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৯ ০২:০৩
Share: Save:

পড়ায় সিরিয়াস হওয়ার সঙ্গে কি আকাশ দেখার বিরোধ আছে! হালের বাবা-মায়েরা এ সবের পরেও বোধের একটা স্তরে তো পৌঁছেছে।

সে সময়ে এত চাপ ছিল না? কে বলেছে ছিল না! এখন তো নম্বর তোলা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। না হলে ৯৯.৯৯% নম্বর পাওয়া সম্ভব! ফলে পড়াশোনার চাপ সব সময়েই ছিল। আগের প্রজন্মেও ছিল। তার আগেও ছিল। তা না হলে এত বড় বড় বিজ্ঞানী-চিকিৎসক-ইঞ্জিনিয়ার কী করে তৈরি হয়েছে? নিদেনপক্ষে শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিও তো পেয়েছেন!

এখন অভিমানের বস্তা পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। এ জন্য আমরা বাবা-মায়েরা দায়ি। আমি সরকারি বাবার ছেলে। অনেক না পাওয়া নিয়ে বড় হয়ে উঠেছি। কিন্তু এখন সে সব অতীতের কথা শোনাতেও ‘ইমেজ’ নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কীয় আক্রান্ত হই। ফলে ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে না যে তার বাবা-মা এমন সমৃদ্ধি-বৈভবের মধ্যে বড় হয়ে ওঠেনি। না চাইলেও পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা’র মতো সব কিছু পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা জানতেই পারছে না কষ্ট-যন্ত্রণার সংজ্ঞা!

এক দিকে, তারা খুব অল্পেতেই ভেঙে পড়ছে আবার অন্য দিকে, সেই তাদের মধ্যেই ইস্পাত-কাঠিন্যের বর্ম পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। না হলে কী মুখে প্লাস্টিক বেঁধে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করে হাতের শিরা কাটতে কাটতে মৃত্যু অভিজ্ঞতা লিখে যেতে পারে কোনও কিশোরী! তার মনের জোর, জেদ কতটা অনুমান করাও আমাদের বাবা-মায়েদের পক্ষে বোঝা কঠিন। শুধু ভেবে যাচ্ছি কতটা নিজের উপরে আর ভালবাসা না থাকলে এমন মৃত্যু স্বেচ্ছায় ডেকে নিতে পারে এক কিশোরী! অথচ এই মনের জোর, জেদ তাকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারত তা অকল্পনীয়!

ক্লাস সিক্সেও নাকি এক বার ওই কিশোরী এ রকম আ্যাটেম্পট নিয়েছিল।লিখেছে— যতই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, ততই আমার ভাল লাগছে। আমি এমন একটা জায়গায় যেতে চলেছি, যেখানে আর কেউ আমাকে টপার হতে বলবে না, কোন কম্পিটিশন নেই, মায়ের আর মুখ দেখাতে অসুবিধা হবে না।

যদিও মনের জোর, জেদ, আর অদম্য ইচ্ছা শক্তি দিয়েই সে টপার! হয়ত শঙ্কা কোথাও ছিল যদি এই সাফল্য ধরে রাখতে না পারি? তাহলে তো জীবন ব্যর্থ! বাবা-মা মুখ দেখাতে পারবে না সমাজে। ভয়ঙ্কর অশান্তির মুখোমুখি হতে হবে। তার চেয়ে পৃথিবী থেকে সরে যাওয়াটাই শান্তির।

এত কষ্ট দিল কেন সে? কত সহজ উপায় ও তো ছিল! আসলে ছোট থেকে চাপ নিতে নিতে সে আর নিজেকে ভালোবাসত না বোধহয়। নিজের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গিয়ে মেকানিক্যাল হয়ে গেছিল। মর্ষকামী হয়ে পড়েছিল। নিজেকে যন্ত্রণা দেওয়ার খেলায় অলক্ষ্যেই মেতে উঠেছিল। অথচ সেই মন আমরা বাবা-মায়েরা পড়তে পারলাম না!

সে তো আগেও নিজেকে শেষ করতে চেয়েছিল। তাহলে আরও একটু সাবধান হতে পারলাম না কেন? অন্ততপক্ষে স্কুলকে জানিয়ে রাখা উচিত ছিল। যে মেয়ে তিন মাস ঘুমোয়নি বলে লিখে গিয়েছে অথচ মা হিসেবে জানলেন না!

নিজের মায়ের কথা মনে পড়ছে—রাত জাগলেই একটু পর পর জিজ্ঞেস করতেন, ‘ঘুমোসনি এখনও! ... ছটফট করছিস!.. শরীর খারাপ লাগছে?.... চোখ বন্ধ কর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি... ।’’ এ রকম আরও কত কী!

কেন শেষ করতে চায় নিজেকে একরত্তি সেই মেয়েটি? এই প্রতি দিনের যুদ্ধ আর তার ভাল লাগে না বোধহয়। ফার্স্ট হয়ে হয়েও ক্লান্ত! সারাজীবন এই প্রতিযোগিতার মধ্যেই থাকতে হবে বুঝে গিয়েছিল— যা ভয়াবহ। দ্বিতীয় হওয়ার ভয় তাকে তাড়া করত হয়তো! সে তো হারতে শেখেনি! নম্বর কম পেয়েও দারুণ থাকা যায় এই অভিজ্ঞতা যে তার নেই! তাই আগেই শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত। শেষ চিঠিতে বাবা-মাকে উল্লেখ করে লিখে গিয়েছে—‘আমি না থাকলে আরও বেশি করে তোমরা আরও বেশি করে অনুভব করবে আমাকে’। এ যেন নিজের সঙ্গে নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা। কিন্তু ব্যক্তিগত দোষারোপ নয়। শুধু সামাজিক একটি ব্যাধি নিয়ে প্রশ্ন জাগে মনে। কেন চলে যাচ্ছে ওরা? কেন ওদের মন পড়া যাচ্ছে না? আসলে শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে আমরা যত ডাক্তার দেখাই তার অর্ধেক ও ভাবিনা মনের অন্দরে বাসা বাধা গোপন অসুখগুলো নিয়ে।

সময়টা ভয়ঙ্কর। শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসন এবং সর্বোপরি আমরা বাবা-মায়েরা এখনও যদি সতর্ক না হই, তাহলে এমন ঘটনা বারবার দেখতে হবে। হৃদয়হীন, কেরিয়ার-কাঙাল বাবা-মায়েরা সাবধান হোন। এখনও সময় আছে। সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠুন। সন্তানকে ভালবাসুন, সন্তানের রেজাল্টকে নয়। সন্তানকে রোবট বানানোর এক হাস্যকর প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে নিয়ে আসার সময় এসেছে। ছেলেমেয়ের মন বুঝুন। গল্প করুন। কেউকেটা হয়ে উঠতেই হবে আপনার সন্তানকে এমন অবাস্তব ধারনা থেকে বেরিয়ে আসুন। জয়েন্টে চান্স না পেলে, পরীক্ষায় দ্বিতীয় হলে বা সায়েন্স নিয়ে না পড়লে আপনারা মুখ দেখাতে পারবেন না পড়শি-বন্ধু-আত্মীয়স্বজনের কাছে— এই ধারনা থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গিয়েছে। আর তা না পারলে ছাত্রছাত্রীরা নিশ্চুপে কুয়াশায় মিলিয়ে যাবে। অটোর সামনের সিটে বসা যাত্রী আজ বলছেন ‘জিডি বিড়লা’র কথা। কাল অন্য স্কুলের কথা....

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Depression Education Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE