Advertisement
১৯ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ২

ইউরোপে মুসলিমরাই কি নতুন ‘অপর’

আগ্রাসী জঙ্গি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংখ্যালঘুর আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞানকেই আঘাত করে তার ধর্মের বিরুদ্ধেই যুদ্ধঘোষণা করে। সেটা কিন্তু সন্ত্রাস দমনের পথ নয়, কারণ তা জেহাদিদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে তোলে।আতঙ্কে কাঁপছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। ইসলাম-আতঙ্ক। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মাদ্রিদের পর প্যারিস। জেহাদি হামলায় তটস্থ, সন্ত্রস্ত ইউরোপ। রাজনৈতিক ইসলামের জঙ্গি, ওয়াহাবি-সালাফি জেহাদ বিপন্ন করে তুলেছে তার সামাজিক সন্তুলন। এতটাই যে, ইউরোপের দেশে দেশে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মুসলিমের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হচ্ছে সন্দেহ, বিদ্বেষ, জাতি-ঘৃণা।

প্রতিক্রিয়া। অভিবাসী-বিরোধী পিইজিআইডিএ’র বিক্ষোভ। ড্রেসডেন, জার্মানি, ১২ জানুয়ারি। ছবি: রয়টার্স।

প্রতিক্রিয়া। অভিবাসী-বিরোধী পিইজিআইডিএ’র বিক্ষোভ। ড্রেসডেন, জার্মানি, ১২ জানুয়ারি। ছবি: রয়টার্স।

গৌতম রায়
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

আতঙ্কে কাঁপছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। ইসলাম-আতঙ্ক। নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, মাদ্রিদের পর প্যারিস। জেহাদি হামলায় তটস্থ, সন্ত্রস্ত ইউরোপ। রাজনৈতিক ইসলামের জঙ্গি, ওয়াহাবি-সালাফি জেহাদ বিপন্ন করে তুলেছে তার সামাজিক সন্তুলন। এতটাই যে, ইউরোপের দেশে দেশে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ মুসলিমের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হচ্ছে সন্দেহ, বিদ্বেষ, জাতি-ঘৃণা। যে উদারনীতি অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন মারফত পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়া থেকে অগণিত মুসলিম ও প্রাচ্যদেশীয়ের ভাগ্যান্বেষণ উত্‌সাহিত করেছিল, তা সঙ্কুচিত করে পুবের সব দরজা বন্ধ করে দেবার দাবি উঠতে শুরু করেছে।

‘শার্লি এবদো’র সদর-দফতরে জঘন্য হত্যালীলার প্রতিবাদে প্যারিসের রাজপথে যে ১০ লক্ষ মানুষ পা মেলালেন, তাঁদের মধ্যে বহু মুসলিমও ছিলেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর এই আক্রমণ যাঁরা সমর্থন করেননি। ঠিক যেমন জেহাদিদের গুলিতে নিহত মুসলিম কনস্টেবল, যিনি ব্যঙ্গচিত্রীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। যে তিন জেহাদি ১৭ জন ফরাসি নাগরিককে হত্যা করে, তারা কেউ প্রথম প্রজন্মের অভিবাসীও নয়। প্যারিসেই তাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, জেহাদি মতে দীক্ষা। প্যারিস ও মার্সাইয়ের বিস্তীর্ণ উপকণ্ঠে প্রসারিত দরিদ্র বস্তিগুলিতে যে ৫০ লক্ষ মুসলিম বাস করে, এরা তাদেরই অংশ। তাদের দারিদ্র, বেরোজগারি, বিচ্ছিন্নতাবোধ আল-কায়দা ও আইসিস বা আইএস তকমাধারী ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের জেহাদি স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহের উর্বর ভূমি। ফরাসি সরকার সে সম্পর্কে অবহিতও ছিল। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, অন্তত ১৪০০ ফরাসি নাগরিকের ইরাক ও সিরিয়ায় জেহাদে যোগ দিতে যাওয়ার সমাচার, যাদের মধ্যে ৭০ জন ইতিমধ্যেই সেখানে নিহত। এই জেহাদিরা সবাই ফ্রান্সে ফিরে এলে কী হবে, তা ভেবেও উত্‌কণ্ঠার শেষ নেই।

পাশের দেশ বেলজিয়ামে গত সপ্তাহেই পুলিশ বেশ কয়েকটি মুসলিম মহল্লায় হানা দিয়ে সিরিয়া-ফেরত দুই জেহাদিকে গুলির লড়াইয়ে হত্যা করেছে। বেলজিয়ামে ৫ লক্ষ মুসলিমের বাস, যারা প্রায় সকলেই উত্তর-আফ্রিকা থেকে অভিবাসী ফরাসিভাষী। ‘শার্লি এবদো’র হত্যাকাণ্ডের পরেই জার্মানির বার্লিনে আড়াইশো পুলিশের দল ১১টি বাড়িতে ভোর রাত্রে হানা দিয়ে দু’জন তুর্কিকে গ্রেফতার করে, ইসলামি রাষ্ট্রবাদীদের যোদ্ধা ও তহবিল সরবরাহ করছে, এই সন্দেহে। জার্মানিতে ৪০ লক্ষ মুসলিমের বাস, অধিকাংশই তুরস্ক থেকে প্রজন্মপরম্পরায় অভিবাসী।

ইসলাম-আতঙ্ক জার্মানিকে যতটা গ্রাস করেছে, আর কোনও ইউরোপীয় দেশকে ততটা নয়। দক্ষিণপন্থী জার্মান তরুণদের সংগঠন পিইজিআইডিএ (যার নামের অর্থ: পশ্চিম দুনিয়ার ইসলামিকরণের বিরোধী দেশপ্রেমী ইউরোপীয়রা) প্রতি সোমবারই দেশের নানা প্রান্তে ইসলাম-বিরোধী বিক্ষোভ-মিছিল সংগঠিত করে চলেছে। ‘শার্লি’র উপর হামলার পর ড্রেসডেন শহরে প্রায় ৫০ হাজার জার্মান বিক্ষোভ দেখায়। সেখানে মুসলিমদের বিরুদ্ধে, জার্মানির অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধেও স্লোগান ওঠে। তরুণরা শ্বেতাঙ্গ, নর্ডিক আর্যত্বের দাবিদার, প্রাচ্যদেশীয়দের কাছে রুজি হারাবার ভয়ে শঙ্কিত, উগ্র জার্মান জাত্যভিমানে টগবগে। এদের ভিড়ে মিশে রয়েছে নব্য-নাত্সিরা। জার্মানদের জন্মহার আশঙ্কাজনক ভাবে কমতে থাকায় অ্যাঞ্জেলা মার্কেল-এর সরকার অভিবাসনে উত্‌সাহ দেয়। ২০১৩ সালে ৪ লক্ষ ৩৭ হাজার লোক এ দেশে অভিবাসী হয়। গত বছর ২ লক্ষ আশ্রয়প্রার্থীকে জার্মানি কোল দিয়েছে, যাদের অনেকেই গৃহযুদ্ধ-ধ্বস্ত সিরিয়া থেকে আগন্তুক। এ সবই যুব সম্প্রদায়ের মনে ইসলাম দ্বারা প্লাবিত হওয়ার ভীতি জাগিয়ে তুলেছে। শার্লি-হামলার আগেই নেওয়া এক জনমত-সমীক্ষায় এই বিপন্নতাবোধের কথা নথিভুক্ত করিয়েছে দেশের অ-মুসলিম নাগরিকদের ৫৭ শতাংশ।

চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের সরকার এই উগ্র মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর বিরুদ্ধে সতর্ক। গত সোমবার রাতে সারা জার্মানি জুড়ে লাখখানেক মানুষ দেশের বহুসংস্কৃতিবাদী ঐতিহ্য ও মুসলিমদের সমর্থনে পাল্টা মিছিল করেন। ঐতিহাসিক ব্রান্ডেনবুর্গ গেট-এর সামনের নৈশ জমায়েতে হাজির হয়ে মার্কেল ঘোষণা করেন, ‘ইসলামও জার্মানির অংশ এবং ধর্মবিশ্বাসের কারণে কোনও জনগোষ্ঠীকে বহিষ্কৃত করা একটি মুক্ত রাষ্ট্রের মৌল নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ দেশে বর্ণবৈষম্য, উগ্রপন্থা ও জেনোফোবিয়া-র স্থান নেই।’ কিন্তু মার্কেলের নিজের দলেরই একাধিক নেতা তত্‌ক্ষণাত্‌ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘তিনি কোন ইসলামের কথা বলছেন, মৌলবাদী সালাফি ইসলাম কি? বস্তুত, জার্মানির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য একান্তই ইহুদি-খ্রিস্টীয়, ইসলাম জার্মানিতে একটি বিদেশি, ‘অপর’।’

জার্মানিতে যদি ইসলাম-আতঙ্ক দক্ষিণপন্থী নব্য-নাত্সিদের শিবিরে ভিড় বাড়াতে থাকে, ফ্রান্সে তবে তার ফসল তুলছে অতি-দক্ষিণ ন্যাশনাল ফ্রন্ট। দলের নেত্রী মারিন ল্য প্যাঁ তাঁর অভিবাসন-বিরোধী, সংযুক্ত-ইউরোপ-বিরোধী মঞ্চ নিয়ে গত বছর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনেই এক-চতুর্থাংশ ভোট পেয়েছিলেন। ফ্রান্সের আর্থিক সঙ্কটের জন্য অভিবাসী, মুসলিম ও খোলা সীমান্তকে দায়ী করে তিনি বলেছেন, ‘ফ্রান্সের রাস্তায় মুসলিমদের নমাজ পড়া দখলদার নাত্সি বাহিনীকে মনে পড়িয়ে দেয়। সাঁজোয়া গাড়ি নেই, অস্ত্রসজ্জিত সেনাও নেই, তবে দখলদারি তো বটেই!’ ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থানের জমি অন্য ভাবেও তৈরি হতে পারে। দশ লক্ষ ফরাসির পথযাত্রায় ‘আমিও শার্লি’ এই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল, যা ধর্মপ্রাণ ফরাসি মুসলিমরা অনুমোদন না-ও করতে পারেন। যে-পত্রিকা পয়গম্বরকে বিদ্রুপ করে, বাক্স্বাধীনতার নামে মুসলিমরা তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করবেন কী করে? তাঁদের বিচ্ছিন্নতাবোধ তো কাটবার নয়, বরং তা আরও গেড়ে বসবে। প্রকাশ্যে মুসলিম নারীর বোরখা পরা নিষিদ্ধ করার মধ্যে যে আগ্রাসী, জঙ্গি ধর্মনিরপেক্ষতা আছে, তা কার্যত সংখ্যালঘুর আত্মপরিচয়ের অভিজ্ঞানকেই আঘাত করে তার ধর্মের বিরুদ্ধেই যুদ্ধঘোষণা করে, এমন কথা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকেও বলতে শোনা গেছে। জেহাদিরা কিন্তু ঠিক এটাই চাইছে। তাদের লড়াই তো আসলে কিছু গোঁড়া ধর্মান্ধ লোকের সংকীর্ণ, নোংরা ধান্দাবাজি। কিন্তু সেটাকেই তারা একটা পবিত্র ধর্মযুদ্ধ বলে চালাতে চায়। তাই এই মতলববাজ ঘাতকদের অভিপ্রায় বানচাল করতে আরও সতর্কতা চাই, ন্যাশনাল ফ্রন্টের যুদ্ধং দেহি মনোভাব নয়।

ইসলাম-আতঙ্ক এমনকী সুইডেন বা ব্রিটেনের মতো সহনশীল গণতন্ত্রকেও মুসলিমদের প্রতি অসহিষ্ণু করে তুলছে। সুইডেনে পর পর তিনটি মসজিদে অজ্ঞাত দুষ্কৃতীরা হামলা চালিয়েছে। মসজিদের দেওয়ালে ‘মুসলমানরা বিদেয় হও’ স্লোগান দেগে দেওয়া হচ্ছে, সঙ্গে স্বস্তিকা চিহ্নও। কুইন্সল্যান্ডের রেস্তোরাঁর দরজায় ‘মুসলিমদের প্রবেশ নিষেধ’ লেখা বোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অস্ট্রিয়ার ফ্রিডম পার্টির প্রধান ইউরোপের ‘নব্য-অটোমান দখল’-এর আশঙ্কা প্রচার করছেন। নেদারল্যান্ডস-এর পার্টি ফর ফ্রিডম বলছে: মরক্কোর মুসলিমদের তাড়াও, হল্যান্ডকে ইসলাম-মুক্ত করো। সে দেশের ৪৭৫টি মসজিদের এক-তৃতীয়াংশের দেওয়ালে হয় নাত্সি স্বস্তিকা চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে, নয়তো বোমা মারা হয়েছে। জনমত সমীক্ষায় ইউরোপের ইসলাম-বিরোধী, অভিবাসন-বিরোধী দলগুলির সমর্থন হু হু করে বেড়ে চলেছে। ব্রিটেনের দক্ষিণপন্থী ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির জনসমর্থনও দ্রুত বাড়ছে। এক দিকে জার্মানি, বেলজিয়াম, ফ্রান্সে জেহাদি সন্দেহে মুসলিমদের বাড়িতে হানা দেওয়া, তাদের গ্রেফতার করা, গুলি চালিয়ে দেওয়ার ঘটনা হঠাত্‌ বেড়ে গেছে, অন্য দিকে সুইডেন থেকে কানাডা, স্পেন থেকে অস্ট্রেলিয়া, সর্বত্র সন্ত্রাস ও জেহাদ রোধ করার নামে রকমারি দমনমূলক আইনকানুন প্রণয়ন করা হচ্ছে। ইউরোপে মুসলিমরা কি ক্রমে ইহুদিদের মতোই ‘অপর’ হয়ে উঠছেন? ইহুদি-বিদ্বেষে নাত্সিরা যে সন্দেহ, অবিশ্বাস, ঘৃণা লালন করত, আজ ইসলাম সম্পর্কে, মুসলিম জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সেই একই বিষাক্ত সংশয় কি ঘনিয়ে তোলা হচ্ছে না, যাতে উস্কানি দিচ্ছে উগ্র-জাতীয়তাবাদী, নব্য-নাত্সি, স্কিনহেডদের মতো দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার শক্তি, যা আবার ওই শক্তিগুলিকেই রাজনৈতিক অপ্রাসঙ্গিকতা ও প্রান্তিকতার উন্মার্গগামী কানাগলি থেকে বেরিয়ে ইউরোপীয় সমাজ ও রাজনীতির মূল ধারায় উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial gautam roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE