প্রথম প্রশ্ন ধর্মের নহে, রাজধর্মের। ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবক্তারা বলিতেছেন, দিল্লিতে কয়েকটি গির্জায় আক্রমণের বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলিকে ধর্মের চশমা দিয়া দেখা ঠিক নহে, মন্দির মসজিদ গুরুদ্বারেও এমন আক্রমণ ঘটে, ঘটিয়াছে। তর্কের খাতিরে এই যুক্তি স্বীকার করিলেও প্রথম প্রশ্নটি অস্বীকার করা যায় না। যে ধর্মের প্রতিষ্ঠানেই হোক, এমন ধারাবাহিক অপরাধ ঘটিবে কেন? ঘটিতে দেওয়া হইবে কেন? পুলিশ প্রশাসন কী করিতেছে? মনে রাখা দরকার, রাজধানীর ক্ষেত্রে এই প্রশাসন স্বাভাবিক অবস্থাতেও কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে, আর এখন তো দিল্লিতে কেন্দ্রীয় শাসনই বহাল। সুতরাং, ২০০২ সালের গুজরাতের দৃষ্টান্ত না টানিয়াও বলা চলে, এ ধরনের প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় কেন্দ্রীয় সরকার এড়াইতে পারে না। কেবল নৈতিক দায় নহে, কার্যকর প্রশাসনিক দায়ও। শোরগোল কিছু বেশি হওয়ার ফলে অবশেষে দিল্লি পুলিশ ধর্মস্থানে প্রহরার আশ্বাস দিয়াছে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।
কিন্তু রাজধর্ম একমাত্র প্রশ্ন নহে। দিল্লির ঘটনাবলির অন্য তাত্পর্যও থাকিতে পারে, থাকিবার আশঙ্কা প্রবল। রাজনীতিকরা যে কোনও অস্বস্তিকর পরিস্থিতিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলিয়া উড়াইয়া দিয়া থাকেন। কিন্তু বলিলেই তাহা উড়িয়া যায় না। বিশেষত যখন ঘটনাগুলির মধ্যে অর্থপূর্ণ যোগসূত্র থাকে। নভেম্বর হইতে এ পর্যন্ত দিল্লির পাঁচটি গির্জায় আক্রমণের ঘটনাগুলির ধরনটি লক্ষণীয়। রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতীরা হামলা চালাইয়া পবিত্র সামগ্রীগুলি লন্ডভন্ড করিতেছে। তাহারা গির্জায় রক্ষিত কোনও মূল্যবান সামগ্রী হস্তগত করিতেছে না। টাকাপয়সা, অলঙ্কার-গহনা সকলই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ-স্পৃষ্ট। কেবল খ্রিস্টীয় উপাসনায় লাগে, এমন পবিত্র সামগ্রী, স্মারক ও চিহ্নগুলি ধ্বংস করা হইতেছে, যাহাতে সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক যে, অপকর্মগুলি ধর্মদ্বেষীদের কাজ। অন্তত যথার্থ তদন্ত এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা করিয়া এই সন্দেহ অপনোদন করা অত্যন্ত জরুরি। তাহা না হইলে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র তত্ত্বটি নিছক অজুহাত হিসাবেই সাব্যস্ত হইবে।
এহ বাহ্য। এই সব ঘটনা ঘটিতেছে এক বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে। প্রেক্ষিতটি উদ্বেগজনক। কেন্দ্রে এনডিএ তথা বিজেপির সরকার প্রতিষ্ঠিত হইবার পরে গত কয়েক মাসে বিভিন্ন উপলক্ষে হিন্দুত্ববাদী নানা নেতা বা গোষ্ঠীর অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ দেখা গিয়াছে, সাধারণ ভাবে এক ধরনের অসহিষ্ণুতার পরিবেশ রচিত হইয়াছে। প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে ভারত সফরে আসিয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাঁহার বিদায়লগ্নে এই ব্যাপারে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার বক্তব্য ছিল, সমূহ সম্ভাবনাময় ভারত তাহার প্রগতির পথে সাফল্য অর্জন করিতে সমর্থ হইবে যদি ধর্মবিশ্বাস লইয়া অসহিষ্ণুতা দেশটিকে বিভক্ত করিয়া না দেয়। এই প্রেক্ষিতে দিল্লির ঘটনাগুলি বিশেষ উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিজেপির নেতা বলিয়া নহেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী বলিয়াই নরেন্দ্র মোদীকে এই ধরনের অবাঞ্ছিত উপদ্রব দমনে দায়িত্ব লইতে হইবে। ইহা রাজধর্মের প্রাথমিক দাবি। নরেন্দ্র মোদী যে উন্নয়নের প্রতীক এবং হোতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহেন, তাহার স্বার্থেও রাজধর্ম পালন করা অত্যাবশ্যক। আশা করা যায়, তিনি সেই দায়িত্ব পালনে তত্পর হইবেন। ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে না হোক, উন্নয়নের স্বার্থে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy