রাজনৈতিক শুদ্ধতার খপ্পরে পড়ে আমাদের একেবারে সাড়ে সর্বনাশ হয়েছে। সে দিনের ওই সহযাত্রীদের সম্বন্ধে যে বিশেষণগুলো ব্যবহার করতে হাত নিশপিশ করছে, রাজনৈতিক শুদ্ধতার কল্যাণে তা মোটেই লেখা যাবে না। বলতে হবে, লোকগুলো অন্য রকম ভাবে ভদ্র এবং শিক্ষিত।
গত ২৭ অগস্ট পুরী বেড়াতে যাচ্ছিলাম। ধারণা ছিল, এসি থ্রি টিয়ারে মোটামুটি ভদ্র ভাবে, নির্ঝঞ্ঝাট যাতায়াত সম্ভব। ভুল ধারণা তো কতই থাকে মানুষের। বামফ্রন্ট বিদেয় হলেই রাজ্য থেকে তোলাবাজি আর সিন্ডিকেটও উধাও হবে, কারও কারও নিশ্চয়ই এমন ধারণাও ছিল।
আমাদের ছিল সাইড লোয়ার আর আপার। ট্রেনে উঠে দেখলাম, সামনের কুপের ছ’টা সিট একটা দলের দখলে। চার মহিলা, তাঁদের এক জন করে স্বামী এবং মোট তিনটি বাচ্চা। সবাই বাঙালি। একটু দূরে অন্য এক কুপে আরও দুটো আসন তাঁদের, কিন্তু গোটা পরিবার একত্র সময় কাটানোই মনস্থ করলেন তাঁরা। ট্রেন ছাড়ার আগেই তাঁদের আলাপ আলোচনায় বোঝা গেল, মা সরস্বতীর সঙ্গে তাঁদের দীর্ঘ দিন ধরে মোকদ্দমা চলছে, এবং সেই মামলায় দেবীর জয়লাভের সম্ভাবনা নেই। তবে, দলের সব পুরুষের গলায় মোটা মোটা সোনার চেন দেখে ভরসা হল, লক্ষ্মীর আশীর্বাদে তাঁরা বঞ্চিত হননি।
রাত দশটা পঁয়ত্রিশে ট্রেন ছাড়ল। আশেপাশের সবাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। আমাদেরও সে রকমই ইচ্ছে ছিল। দেখা গেল, সহযাত্রীরা আর্লি টু বেড-এ বিশ্বাসী নন। তাঁদের আড্ডা শুরু হল। দুটো বাচ্চা নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য, তৃতীয়টি স্বভাবে খানিক জাতির জ্যাঠামশাই। দু’চারটে কথা বলে যখন দেখল, বড়রা সাঁটে আদিরসাত্মক আলোচনায় ঢুকে পড়েছেন, একটি মোবাইল দখল করে সে সশব্দ গেম খেলতে শুরু করল। আড্ডা আর গেমের যুগলবন্দি চলল। ভাবলাম, আহা থাক, অনেক দিন পর সবাই একত্র হয়েছেন, না হয় একটু গল্প করলেন।
পৌনে বারোটা নাগাদ বোঝা গেল, কর্মসূচি আরও অবশিষ্ট আছে। ঝুলি থেকে টিফিন বক্সেরা বেরোল। এ দিকে আমার কন্যা তখন ঘুমে ঢুলছে। ঘুমোতে পারছে না, ফলে তার মেজাজের পারদও চড়ছে। বাবা-বাছা করে বোঝালাম, আর একটু অপেক্ষা কর মা। ট্রেনের খাওয়া কত ক্ষণই বা? সে খাওয়া শেষ হল সাড়ে বারোটায় খড়্গপুর পার করে।
রাতের খাওয়া শেষ হওয়ার পর আর ট্রেনে কীই বা করার থাকে? গলা খাঁকরে আর্জি জানালাম, এ বার যদি দয়া করে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েন, চার বছরের মেয়েটা একটু ঘুমোতে পারে। জবাবে প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে বজ্রনির্ঘোষ: ট্রেনে চড়লে যে বাড়ির সুবিধাগুলো পাওয়া যায় না, সেটা আমার মনে রাখা উচিত ছিল। সহযাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধাও তো দেখতে হবে। তাঁরা তো আর এমনি আলো জ্বালিয়ে রাখেননি, অন্ধকারে যে খাওয়া যায় না, এটাও কি আমি জানি না ইত্যাদি। তিরস্কৃত আমি অধোবদন। তবে অস্বীকার করব না, আমাদের দিকটাও দেখেছিলেন তাঁরা। দেড়টা বাজার আগেই আসর গুটিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়েছিলেন।
ওই উন্নতিশীল ভবদুলালরা সংবাদপত্র পড়েন, তা-ও সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা, এ দুরাশা আমার নেই। ভাগ্যের কোনও গূঢ় চক্রান্তে এই লেখা তাঁদের চোখে পড়লেও যে তাঁরা বা তাঁদের পরিজনরা বিন্দুমাত্র লজ্জিত হবেন, সেটাও সম্ভাবনার অপর পারে। এই লেখাটা আসলে ‘সহবত’ শব্দটার শোকগাথা। ইদানীং তেমন শুনি না, কিন্তু আমাদের শৈশবেও শব্দটা বেশ প্রচলিত ছিল। ভদ্রজনের সঙ্গে থেকে ভদ্রতার যে শিক্ষা, তার নাম সহবত। কথাটা উঠে গেছে। জিনিসটাও। এখন গা-জোয়ারির কাল।
অনেক গা-জোয়ারি গায়ে সয়ে গিয়েছে। অটোওয়ালা থেকে পাড়ার ক্লাব হয়ে রাজনৈতিক চুনোপুঁটি, সবার অসভ্যতাই হজম করে ফেলি। ভবিষ্যতে এমন সহযাত্রীদেরও অনেক খোলা মনে, অনেক সহজে মেনে নিতে পারব বলেই বিশ্বাস। তবু ভাবি, কেমন হত, যদি অন্তত ছোটরা ফের সহবত শিখত? শিখত, নিজেরটুকু বাদ দিলেও পৃথিবীর খানিকটা বাকি থাকে, আর সেই বাকিটুকুকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে হয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy