তখন শান্তিকল্যাণ। ময়দানে বামফ্রন্টের মহামিছিলের প্রস্তুতি। সেপ্টেম্বর ২০০৪। ছবি: অশোক মজুমদার।
আজকাল গণতন্ত্রের নাচ বলে একটা শব্দ শোনা যাচ্ছে। এর কোনও পারিভাষিক অর্থ আছে কি না, তা আমার মতো নানার্থবাদী মগজে প্রবেশ করে না। তবে এই ভোটের সময়েই গণতন্ত্রের প্রকৃত নাচ আরম্ভ হয়, এই নাচই শেষ পর্যন্ত কারও হাত-পা ভেঙে দেয়, আবার কাউকে বা পটীয়ান শিল্পীতে পরিণত করে। তবে একটা কথা মানতেই হবে। গণতন্ত্রের এই নাচ পশ্চিমবঙ্গে আগে বড় দেখিনি, শুধু এখনই দেখতে পাচ্ছি। মনে আছে, সিদ্ধার্থশঙ্করের আমলে এক বার ভোট হল, সেখানে কংগ্রেসের আসনসংখ্যা দেখে তাক লেগে গিয়েছিল। তার পর বাম-আচারীরা এলেন। তাঁদের তো আবার তান্ত্রিক সাধনা, মারণ-উচাটন-বশীকরণ এই ত্রয়ীবিদ্যা এত মধুর নিস্তব্ধতায় তাঁরা রপ্ত করে ফেললেন যে, পাঁচ বছরের মধ্যেই হাটে-মাঠে-গৃহে-গোঠে সর্বত্র বামেদের কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত হয়ে উঠল— দেখলাম, কলেজের প্রিন্সিপাল থেকে মাস্টার, নন-টিচিং থেকে ছাত্র, সকলের এক সুর। শ্রমিক-মালিকের কণ্ঠস্বর এক, জোতদার-কৃষক দু’পক্ষই পার্টি ফান্ডে সরবরাহের সুরে আছেন। যে দিকে তাকাই, বাম। গুটিকতক কংগ্রেস নেতাকে দেখতাম, কী পরম নিশ্চিন্তে তাঁরা ভাতঘুম দিতেন। আমরা কী সুখে কাল কাটাইতাম!
গণতন্ত্রের নাচ কোথায় ছিল সে দিন? কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোতে বিভিন্ন বিভাগে অনন্ত মেধাহীন অধ্যাপকদের প্রবেশ ঘটল ধীর পদসঞ্চারে একটি-একটি করে, একটু-একটু করে সে দিন কি একটাও উচ্চ স্বর প্রতিবাদ হয়েছে? সংবাদপত্রে কোনও খবর? বাম-বিরোধী জায়গায় থেকে আন্দোলন করে, ধর্না দিয়ে একটা মাত্র দাবি সরকার মেনে নিয়েছে, কেউ দেখাতে পারবেন? আবার ‘আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে বাম-আন্দোলনের একটা বড় ভূমিকা আছে’ এটাই যদি প্রমাণযোগ্য একটা কর্তব্য হত, তা হলে অদ্ভুত কৌশলে সেটা করা হত। ধরা যাক, কলেজ-ইউনিভার্সিটির মাস্টারদের পে-রিভিশনের পর দু’বছরের বকেয়া টাকা আসছে না, তখন কিন্তু কোনও আন্দোলন নেই। প্রশ্ন করলে নেতারা বলতেন, ব্যাপারটা কি অতই সোজা! প্রত্যেক প্রদেশে ক’টা কলেজ, ক’টা ইউনিভার্সিটি, খবর রাখেন কিছু? আপনি তো আপনার টাকাটা নিয়ে ভাবছেন, আমাদের সর্বভারতীয় দৃষ্টিতে ভাবতে হয়। এই ‘মহতো মহীয়ান’ দৃষ্টিভঙ্গি অনুধাবন করে সাধারণ অতিপ্রত্যাশী অধ্যাপকেরা লজ্জায় মাথা নত করতেন। তার পর বুঝেছি, যেই না মন্ত্রী-মহলে খবর ঢুকল যে, নিজস্ব গতিতেই ইউ জি সি-র টাকা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকছে, সেই খবর ওয়েবকুটা-কুটার নেতাদের কানে আগাম যাওয়া মাত্রেই এক বিরাট আন্দোলন-মিছিলের ব্যবস্থা করতেন তাঁরা। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রতিনিধিরা প্রতিবেদন নিয়ে যেতেন। তার পর নকল হাসিতে চা-সন্দেশ খেয়ে এসে মিছিলের অগ্রমুখে দাঁড়িয়ে বলতেন— খুবই সদর্থক কথা হয়েছে। মন্ত্রী-মশাই কথা দিয়েছেন, অবিলম্বে দিল্লিতে গিয়ে আমাদের সকলের দাবি পূরণের ব্যবস্থা করবেন।
আমরা আশ্বস্ত মনে বাড়ি ফিরতাম এবং এক সপ্তাহের মধ্যে খবর পেতাম, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রীর চাপে আমাদের আন্দোলন সার্থক হয়েছে। প্রাপ্য টাকা এসে গিয়েছে। এই কপট নাটক এবং এই নাটকীয় আন্দোলন আমার জীবনে আমি তিন বার দেখেছি। কিন্তু তখন বিরোধীদের, বিশেষত কংগ্রেসওয়ালাদের কোনও গণতান্ত্রিক নৃত্য দেখিনি। স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা, কলেজ সার্ভিসের পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, রেজাল্ট অদ্ভুত এক শৈত্যপ্রবাহের বৃত্তে আবর্তিত হত, কোনও আন্দোলন, কোনও ধরনা, রক্তাক্ষরে লেখা কোনও চিঠি পড়তে পাইনি। মহাশয়, আপনারা কিছু জানতেই পারতেন না, শরীরের কোন গভীরে ধর্ষণ ঘটে গিয়েছে অনালোক স্তব্ধতায়, ধর্ষিতা এবং ধর্ষক সেখানে একত্তর হয়ে যেতেন নাগরিক শাসনে। আন্দোলন, আদালত, সুপ্রিম কোর্ট তখন পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক দূরে ছিল।
আসলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ চৌত্রিশ বছর ধরে যে পাথরটার তলায় চাপা পড়ে ছিলেন, তার সংস্কারটা এমনই যে, কোনও ঘটনা যেন প্রবল নৈঃশব্দ্য ছাড়া ঘটারই কথা নয়, এবং যদি বা ঘটেও, তা হলেও কোনও কথা হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক পরিবর্তনের আগে এই কথাটা বেশ উচ্চকণ্ঠে বলতেনও বামেরা। বলতেন, সব কিছু বড় শান্তিতে চলছে, এই শান্তিটাকে নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছে এই তৃণমূলী লোকেরা। এক বারের তরেও কিন্তু তাঁরা ভাবেননি, গণতন্ত্রে এমন শান্তি আসে কেমন করে? গণতন্ত্রে তো এমন ‘উদার বৈরাগ্যময় বিশাল বিশ্রাম’ থাকার কথা নয়। আমরা শুধু বলি, এই যে এত কথা বলতে পারছেন, এত আরোপ লাগাচ্ছেন, এটা গণতন্ত্রের স্বাধিকার কি না, এটাই গণতান্ত্রিক নাচ কি না?
সত্যি বলছি, তৃণমূলী নেতাদের আমার একটা প্রস্তাব আছে। আপনারা যদি চান যে, চ্যানেলে-চ্যানেলে বাম-ডান কথক-ঠাকুরেরা একটিও দ্বন্দ্ব-সমাস ব্যাসবাক্যে পরিণত করবেন না, যদি চান প্রত্যেকটি ধর্ষণ-ঘর্ষণ-খুন-বাটপাড়ি ঘটার মুহূর্তকাল পরেই কোনও ভৌতিক আবরণে ঢাকা পড়ে যাবে, মুষ্টিমেয় কংগ্রেস নেতারা আপনার অঞ্চল-ছায়ায় বসে থাকবে, তা হলে সমস্ত কিছু আপনাদের শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। এটি এমন এক শিল্প, যা বামেদের সামান্য ছাত্র-নেতা থেকে পাড়ার লোকাল কমিটির মাথা, ফ্রন্টের চেয়ারম্যান থেকে প্রতিটি জেলা-কমিটির সদস্য গভীর জীবনবোধে রপ্ত করেছেন।
কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবটা ছিল শৈল্পিক সূক্ষ্মতার। এই সূক্ষ্মতা তৃণমূলীরা কী ভাবে রপ্ত করবেন! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যা-কিছুই বলুন, তাঁকে অস্বচ্ছ বলা অতি-বড় শত্রুর পক্ষেও অসম্ভব, ঠিক যেমন অসম্ভব মনমোহন সিংহকেও অসৎ বলা। অথচ দেখুন, তাঁর সময়েই টু-জি কেলেঙ্কারি, কয়লা কেলেঙ্কারি ঘটল। একই ভাবে সারদা-সুদীপ্তর জন্ম এবং ফেঁপে ওঠার সমস্ত উপকরণ কিন্তু বাম আমলের ঘটমান অতীত।
ঘটনা হচ্ছে, আপনি যে আসন্ন ভোটের ঠিক আগে এক জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রশ্ন তোলাচ্ছেন, এটা কি গণতান্ত্রিক নাচ, না কি অসম্ভাব্য থার্ড ফ্রন্টের সূক্ষ্ম শিল্পচেতনা?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy