Advertisement
E-Paper

তবে একলা কাটো রে

গাধারা বলে, বাস্তবে যদি মানুষ গাল দেয়, সিনেমায় দেবে না কেন? সিনেমা তো সমাজেরই টুকরো? আরে না, সিনেমার সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক নেই, ফুর্তির আছে।আমাকে বলছে স্বৈরাচারী! আমারই বোর্ডের দুই সদস্য আমার নামে অভিযোগ তুলে বলছে, আমি যুক্তি মানি না, নিয়ম মানি না, নিজের ইচ্ছেমত যা খুশি দৃশ্য কেটে দিই! আরে, বেশ করি! তা-ই যদি না করব, তা হলে সেন্সর বোর্ডের প্রধান হয়েছি কী করতে? এই মহান দেশের বিশাল ম্যাপটাকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে কে? না, আত্মত্যাগের আদর্শ নয়, লাঠি-হাতে গাঁধীমূর্তিও নয়, সেই ঐক্য-রিবন হইল গিয়া সিনেমা। ভারতের ফিলিমই ভারতের আত্মা।

শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০১:৪৭

আমাকে বলছে স্বৈরাচারী! আমারই বোর্ডের দুই সদস্য আমার নামে অভিযোগ তুলে বলছে, আমি যুক্তি মানি না, নিয়ম মানি না, নিজের ইচ্ছেমত যা খুশি দৃশ্য কেটে দিই! আরে, বেশ করি! তা-ই যদি না করব, তা হলে সেন্সর বোর্ডের প্রধান হয়েছি কী করতে? এই মহান দেশের বিশাল ম্যাপটাকে এক সুতোয় বেঁধে রেখেছে কে? না, আত্মত্যাগের আদর্শ নয়, লাঠি-হাতে গাঁধীমূর্তিও নয়, সেই ঐক্য-রিবন হইল গিয়া সিনেমা। ভারতের ফিলিমই ভারতের আত্মা। সেই আত্মার হেডমাস্টার হলাম আমি। তা হলে আমিই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ নই? আমিই কি কাঁধে বইছি না গোটা দেশকে ফিনাইল দিয়ে ধোওয়ার পবিত্র দায়িত্ব?

আগে তবু সিনেমায় বেসিক ভদ্রতা ছিল। হিরো-হিরোইনের চুমু-ইচ্ছে জাগলে, দুটো ফুল ঝুঁকে ঝুঁকে পাপড়ি-ছোঁয়াছুঁয়ি করত। গালাগালির তো প্রশ্নই ছিল না, সবাই সবার সঙ্গে শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার করত। বেশ্যাপাড়ার সম্তান আর সতেরোটা পাশ-দেওয়া শিক্ষকের কথাবার্তার মধ্যে টার্ম-ব্যবহারের তফাতই থাকত না। কী মহান ভাবনা আর শিল্পের যুগ! তার পর এই সর্বনাশা সময়ে, কতকগুলো শয়তানের গাছ ভেবে বসেছে, ভারতের ফিলিম হবে পাশ্চাত্যের টুকলি। ওরা অসভ্য জাত, নোংরামির আখড়া করেছে ওদের ছবিগুলোকে। আর ওদের চক্রান্তই হল সেগুলোকে আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে, চরিত্রটা নষ্ট করে দেওয়া। কী বেলেল্লা সব দৃশ্য! বাড়ির বাচ্চাদের নিয়ে বসে দেখা যায় না! স্বামী-স্ত্রী হরবখত চুমু খাচ্ছে। অফিস যাওয়ার সময় অবধি আইলাভিউ বলছে। ভাবা যায়! এই সব বিশ্বায়নের পোকাগুলো এসে আমাদের পূত পুঁথির পাতা কুরে কুরে খেল, আর কতগুলো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি সে সবকে তোল্লাই গিয়ে হাঁকল, এই নাও, স্মার্ট হও, ছোটকা ছোটকা স্কার্ট পরো, মুখেভাতে মদ খাও। ছিছি! একে রোখার জন্যে একটা মহাপুরুষ চাই। একটা কুঠার হাতে পরশুরাম। আয়নায় পরশু তাকিয়ে আমি রামকে দেখেওছি!

আমার বোর্ডের বাকি মক্কেলগুলোর না আছে শিরদাঁড়া, না আছে সমাজ-সংস্কারের কালাপাহাড়ি খাঁড়া। আরে, বিপ্লব করতে গেলে তো রাফ অ্যান্ড টাফ হতেই হবে। আমি তো বলছি, স্ক্রিপ্ট-সিচুুয়েশন-বক্তব্য-ট্রিটমেন্ট কিস্যু দেখতে হবে না, ধড়াধ্ধড় সব নগ্নতা হাটাও। সব খিস্তি হাটাও। ভারতকে স্বচ্ছ করো। আমার অ্যাকশন হিরো হচ্ছেন মোদী। আমিই তো ‘হর হর মোদী, ঘর ঘর মোদী’ ভাইরাল ক্যাম্পেনটা প্রযোজনা করেছি। সাধে তো এই চেয়ার আঁকড়ে বসিনি! সেই রেলায় ২৮টা খিস্তির লিস্টি টাঙিয়ে দিলাম, ফতোয়া দিলাম এ সব চিরতরে বাদ, কোনও দিন কোনও ফিল্মে উচ্চারণ করা যাবে না ও বাবা, সেই নোটিসের বিরুদ্ধে সরকারকে কী সব বলেকয়ে কতকগুলো জাঁহাবাজ ব্যানটাকে উঠিয়ে নিলে। আমি ছাড়ি? এখন আমি একা বসছি। রেটে খিস্তি কাটছি। সেক্স কাটছি। দেশ যদি সাথ না দেয়, আমাকে একাই জঞ্জাল সাফ করতে হবে। যদি তোর কাঁইচি দেখে কেউ না আসে, একলা কাটো রে!

কতকগুলো গাধা বলে, বাস্তবে যদি যৌন বখেড়া ঘটে, বাস্তবে যদি মানুষ মানুষকে গালাগাল দেয়, তা হলে সিনেমায় তা দেখানো যাবে না কেন? সিনেমা তো সমাজেরই টুকরো? জীবনেরই প্রতিফলন? আরে না রে গাড়লা! সিনেমা মানে হল এন্টারটেনমেন্ট! এর সঙ্গে জীবনের সম্পর্ক নেই, ফুর্তির আছে। অবসর কাটানোর জন্যে লোকে যেমন পিকনিক যায়, তেমনই মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখে। জীবন দেখতে চাইলে একটা লোক খামকা সিনেমা হল-এ ছুটবে কেন? বারান্দায় দেড় ঘণ্টাটাক বসে থাকলে তো মিনিমাগনা জীবন দেখতে পাবে! শোন ভাই, লোকের জীবনে বহুত ক্যাচড়া, বহুত কাচড়া, দুর্গন্ধ বেরচ্ছে, পোকা ভনভনাচ্ছে। সেগুলোকে এসকেপ করার জন্যেই পাবলিক টিকিট কাটছে। হল অন্ধকার হলে, সে চলে যাবে এমন একটা রাজ্যে, যেখানে সবাই মাইনে পায়, গাছে চকোলেট ফলে, বর-বউ পূর্ণিমা রাতে বিছনায় বসে গজল গায়, তার পর হজমের ওষুধ খেয়ে উল্টো দিক ফিরে শুয়ে পড়ে। যদি সে এগুলো না-ও চায়, তাকে চাওয়াতে হবে। সৌন্দর্য শেখাতে হবে। ভারতীয় সৌন্দর্য। রাস্তাঘাটের ধুলো না-লাগা, ফিল্টার করা সৌন্দর্য। হলিউডকে, ‘ফিফটি শেড্স অব গ্রে’-কে ঘেঁটি ধরে গেট আউট করতে হবে। ইন্টারনেটের ওপর ক্যাঁক করে শেকল লাগাতে হবে। তার পর টিভি-অ্যাড, হোর্ডিংগুলোর কান টেনে ধরতে হবে। ভারতীয় ঐতিহ্যের স্ট্যাম্প সবার মুখের ওপর পুরু ধ্যাবড়া করে মারতে হবে।

আরে, এখন একটা সুন্দর সময় আসছে ভারতে, জগৎসভায় আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছি, গরু জবাই নিষিদ্ধ হচ্ছে, আর একটু এফর্ট দিলেই মেয়েদের জিন্স পরা বারণ করে দেওয়া যাবে, এর মধ্যে সিনেমায় যত্ত আন্টিসান্টি কাণ্ড এসে দুধে চোনা ফেলে দেবে? কী বললি? ভারতের অ্যাত্ত বড় ইতিহাসে নানা সময় নানা মূল্যবোধ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে? আমি ঠিক কোন সেট-টাকে ভারতীয় ঐতিহ্য বলছি? অ্যায়, বাতেলা মারিস না! ১৯৮২ থেকে সিনেমা প্রোডিউস করছি। আমার প্রযোজিত ফিল্মেই গোবিন্দা, চাংকি পান্ডে কেরিয়ার শুরু করেছে। ‘শোলা আউর শবনম’ বিরাট হিট, ডেভিড ধবন পরিচালক। এগুলোই সুস্থ সংস্কৃতি। আর্টের অজুুহাতে যত্ত নোংরা প্যাঁচালো হিজিবিজি নিয়ে রগড়ানিকে তোল্লাই দেওয়া যায় না। প্রথমত ভারতে কোনও খারাপ ব্যাপার নেই। দ্বিতীয়ত, যদি থাকেও তা নিয়ে হল্লা করার চেয়ে চেপে যাওয়াটাই ভদ্রতা। তৃতীয়ত, মাইল্ড কোমর-ঝাঁক্কি ড্যান্স লাগিয়ে দে, বাকি ভাবতে হবে না। কী বললি? লোকে মোবাইলে ক্লিপিং দেখছে, সেন্সরের ঢক্কানিনাদ ফক্কা? চুমু অ্যালাও করতেই হবে? বেশ তো, করব। কিন্তু ২৮ রকম চুমু ব্যান করে দেব। তখন ঠোঁট খুলবি কেমনে?

লেখাটির সঙ্গে বাস্তব চরিত্র বা ঘটনার মিল থাকলে তা নিতান্ত অনিচ্ছাকৃত, কাকতালীয়।

post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy