ফাঁকিবাজিতেই কার্যসিদ্ধি হইলে কাজ করে কোন আহাম্মক! সন্দেহ হয়, ইহাই পশ্চিমবঙ্গের মেডিক্যাল কলেজগুলির বীজমন্ত্র হইয়াছে। রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলির পরিকাঠামোর উন্নতিসাধনের প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা বহু কাল চোখে পড়ে নাই। এ দিকে, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার পর্যবেক্ষকরা আসিলে তাঁহাদের কিছু তো দেখাইতে হয়। অতএব, যে কলেজে পরিদর্শন, অন্য মেডিক্যাল কলেজ হইতে সেখানে চেয়ার-টেবিল তো বটেই, চিকিৎসক ও শিক্ষকদেরও কয়েক ঘণ্টার জন্য ধার করিয়া আনা হয়। পরিদর্শন শেষ হওয়ামাত্র ধার পরিশোধ ও পুনর্মূষিকো ভবঃ। অর্থাৎ, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালার আধুনিক সংস্করণ।
চৌর্যবিদ্যার বৃহত্তম বিপদ হইল, আজ না হউক, পরশুর পরের দিন ধরা পড়া প্রায় নিশ্চিত। তবে, ধরা পড়িলেই যে শাস্তি হয়, এমনটা দাবি করিবার কোনও উপায় নাই। মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-র হাতে পশ্চিমবঙ্গ পর পর তিন বার ধরা পড়িল। এই বার তিনটি মেডিক্যাল কলেজের ঝাঁপ ফেলিয়া দেওয়া এবং অন্য কিছু কলেজে আসনসংখ্যা অনেক কমাইয়া দেওয়ার সুপারিশ করিয়াছিল কাউন্সিল। অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য সুপারিশ। ছাত্ররা ইতিহাস পড়িতে ভর্তি হইয়া পরিকাঠামোর অভাবে কিছু না শিখিলে ক্ষতি। কিন্তু ডাক্তারি পড়িতে আসিয়া কিছু না শিখিলে তাহা মানুষ মারিবার কল। এমনিতেই এই রাজ্যের মানুষ জ্বরজারির অতিরিক্ত কোনও অসুখ হইলে চোখ বুজিয়া ভিন্ রাজ্যের ট্রেনে চাপিয়া বসেন। ‘অশিক্ষিত’ ডাক্তারে বাজার ভরিয়া গেলে উদরাময়েও চেন্নাই যাত্রা ভিন্ন উপায় থাকিবে না। কিন্তু, কাউন্সিল শেষ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকিতে পারিল না। প্রতি বারের ন্যায় এই বারও রাজ্য সরকার মুচলেকা দিল মাত্র চার মাসের মধ্যেই সমস্ত ঘাটতি মিটাইয়া ফেলা হইবে! কাউন্সিল এই মুচলেকা মানিল কেন, সেই উত্তর পাওয়া যায় নাই।
ফাঁকি দিয়া পরীক্ষায় পাশ করিবার প্রবণতা এবং ধরা পড়িলে স্টেজে মারিয়া দেওয়ার ঘোষণা, দুইটি একই মানসিকতার ফসল। কোনও কিছুকেই গুরুত্ব না দেওয়ার, ‘চলিতেছে-চলিবে’ মার্কা বঙ্গজ মানসিকতা। বহু বৎসরে যে পরিকাঠামোর উন্নতি হয় না, মাত্র চার মাসেও যে তাহা হইবে না, স্বাস্থ্যকর্তারা ছাড়া সকলেই মানিবেন। পরবর্তী মুচলেকার খসড়া করিতেই সম্ভবত এই চারটি মাস ব্যয় করা হইবে। রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলির পরিকাঠামোর উন্নতি যে মেডিক্যাল কাউন্সিলের স্বার্থে নহে, রাজ্যের স্বার্থেই জরুরি, এবং তাহা রাজ্যের মাথাব্যথার কারণ হওয়াই বিধেয়, এই সহজ কথাটি কর্তারা বুঝিবেন না। কারণ তাঁহারা জানেন, কাউন্সিলের খাঁড়া এড়াইতে পারিলেই দায়িত্ব শেষ। উন্নততর মেডিক্যাল কলেজ তৈরির জন্য তো ভবিষ্যৎ আছেই। যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতেই স্বাস্থ্য দফতরের ভার রাখিয়াছেন, সেই রাজ্যেই এই অবস্থা! কেন পরিকাঠামোর উন্নতির বিষয়টিকে রাজ্য সরকার গুরুত্ব দেয় না, সেই প্রশ্নের উত্তরে রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা বলিয়াছেন, আর একটু সময় পাইলেই তাঁহারা পরিকাঠামোর ঘাটতি মিটাইয়া ফেলিবেন। জন মেনার্ড কেইনস জীবিত থাকিলে তাঁহার অমোঘ উক্তিটি আরও এক বার করিতেন দীর্ঘমেয়াদে আমরা সবাই মৃত। এই বার কথাটি আরও অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত হইত। যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উপর আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করিয়া আছে, তাহার উন্নতির জন্য দীর্ঘমেয়াদের ভরসায় থাকিলে মৃত্যু ভিন্ন আর কোনও বিকল্প থাকে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy