বিক্ষোভ। ইজরায়েলি দূতাবাসের সামনে। আঙ্কারা, তুরস্ক। ১৮ জুলাই, ২০১৪। ছবি: এএফপি
গাজায় সংঘর্ষের প্রায় মাসখানেক অতিবাহিত। ইজরায়েলি পক্ষে নিহতের সংখ্যা মাত্র ষাট, যাদের সকলেই সৈন্য, যোদ্ধা। আর প্যালেস্তিনীয় নিহতের সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়েছে, যাদের অধিকাংশই নিরীহ, নিরস্ত্র শিশু-বৃদ্ধ-মহিলা। তবু এখনও পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলি সে ভাবে প্রতিবাদে মুখর নয়। এটা নতুন ব্যাপার। দু’বছর আগেও যখন গাজায় ইজরায়েলি সৈন্যরা অভিযান চালায়, মিশরের নেতৃত্বে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি প্রভৃতি রাষ্ট্র তখন জায়নবাদীদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেছিল।
এই পরিবর্তনের রহস্য একটাই— আরব বসন্তের প্রতিক্রিয়া। মিশরে হোসনি মুবারক বিরোধী গণ-আন্দোলন যে মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্ষমতাসীন করেছিল, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে জেনারেলরা তখ্তে ফিরেছেন। প্রেসিডেন্ট আবদেল-ফাতা আল-সিসি মুসলিম ব্রাদারহুডের মতোই বিপজ্জনক মনে করেন গাজার শাসক আল-হামাসকে। সৌদি আরবের রাজতন্ত্র এবং আমিরশাহিও তা-ই মনে করে। জর্ডনের রাজাও সে দেশে প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুদের উপস্থিতিকে অস্বস্তিকর মনে করে এসেছেন। আরব বসন্ত পশ্চিম এশিয়ার দেশে দেশে রাজনৈতিক ইসলামের যে-উজ্জীবন ঘটিয়েছে, তার যে-জঙ্গি চেহারা সর্বসমক্ষে উন্মোচিত হয়েছে, প্রতিক্রিয়াশীল রাজতন্ত্র ও ফৌজি শাহির স্থায়িত্বের পক্ষে তা বিপদঘণ্টারই ধ্বনি। ইজরায়েলি আক্রমণে বিধ্বস্ত গাজার শাসক গোষ্ঠী আল-হামাসকে ওই রাজনৈতিক ইসলামের উত্থানের সঙ্গে একাকার করে দেখা অস্বাভাবিক নয়। তাই বিনিয়ামিন নেতানিয়াহুর চেয়েও হামাসকে তারা এই মুহূর্তে ভয় পাচ্ছে বেশি। অতএব ইজরায়েলি হানাদারির বিরুদ্ধে তাদের সমবেত নীরবতা কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।
সম্ভবত এ জন্যই মিশরের ফৌজি প্রেসিডেন্ট জেনারেল আল-সিসির দায়সারা যুদ্ধবিরতি-প্রস্তাবে ইজরায়েলের দেওয়া সব শর্তই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু হামাস নেতৃত্বের কোনও শর্তই তাতে গুরুত্ব পায় না। সৌদি আরবের রাজা আবদুল্লাও মিশরের প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন। মিশরের বর্তমান শাসকদের বাধ্যবাধকতা বোঝা কঠিন নয়। এক বছর আগেই মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আল-সিসি এখন ব্রাদারহুড নেতাদের গণ-মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে ব্যস্ত। ব্রাদারহুড নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তার অভিভাবকত্বে বিকশিত হামাসকেও পেড়ে ফেলা যাবে। এ সময় হামাসকে কোণঠাসা করা তাই তাঁরও একান্ত অভিপ্রায়।
অন্য একটা যুক্তিও শোনা যাচ্ছে। প্যালেস্তাইন মানেই গাজা নয় (ওয়েস্ট ব্যাংকও তো প্যালেস্তিনীয়-অধ্যুষিত), আর গাজা মানেই হামাস নয়। সুতরাং হামাস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ইজরায়েলের অভিযানকে প্যালেস্তিনীয়-বিরোধী অভিযান বলা হবে কী করে? অথচ ঘটনা হল, হামাসের জঙ্গিরা নয়, ইজরায়েলি বোমা ও গোলায় মরছে অগণিত প্যালেস্তিনীয় শিশু-মহিলা-বৃদ্ধ, যারা সবাই হয়তো হামাসের সমর্থকও নয়, কিন্তু হামাসকে উচ্ছেদ করার শক্তিও যাদের নেই। অথচ হামাসকে ক্ষমতাসীন রাখার নিরুপায় অপরাধেই গাজার অসহায় প্যালেস্তিনীয়দের হাজারে-হাজারে প্রাণ দিতে হচ্ছে।
প্রতিবেশী আরব দেশগুলিতে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয়প্রার্থী প্যালেস্তিনীয়রা প্রথম থেকেই বিশেষ সমাদৃত হয়নি, বরং উটকো আপদ রূপেই চিহ্নিত থেকেছে। পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তর কূটনৈতিক মঞ্চে মানবিক ভাবমূর্তি বজায় রাখতে আরব রাষ্ট্রপ্রধানরা প্যালেস্তিনীয়দের জন্য মায়াকান্না কাঁদলেও ভিতরে-ভিতরে উদ্বাস্তুদের উপর কড়া নজরদারি চালিয়েছেন, যাতে তারা আশ্রয়দাতার ঘরে সিঁদ কেটে তার স্থায়িত্ব বিপন্ন করতে না পারে। ইয়াসার আরাফত যত দিন প্যালেস্তিনীয়দের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন, তত দিন আল হামাসের মতো সংগঠনও সে ভাবে মাথা তুলতে পারেনি। কিন্তু ক্রমশ আরাফতের কর্তৃত্ব শিথিল হতে থাকলে তারাও রাজনৈতিক শক্তি জাহির করতে থাকে। লক্ষণীয়, দরাদরির ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যেই ওয়েস্ট ব্যাংক শাসনকারী পিএলও নেতা মাহমুদ আব্বাস সম্প্রতি হামাসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিখণ্ডিত প্যালেস্তাইনে অভিন্ন শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে। সেই বন্দোবস্তে হামাসই যে শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য পাবে, এমন আশঙ্কা থেকেই তার মাজা ভেঙে দিতে ইজরায়েলের সমরাভিযান। আর মিশর, জর্ডন, সৌদি আরব ও আমিরশাহিও একই শঙ্কা থেকে ইজরায়েলের ঘাড়ে বন্দুক রেখে হামাসকে নির্মূল করার স্বপ্ন দেখছে।
এই বৃত্তের বাইরে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় যে সব মুসলিম রাষ্ট্র, তাদের অনেকেই রাজনৈতিক ইসলামের পুনরুত্থানের ধাক্কায় ঘর সামলাতে ব্যস্ত, প্যালেস্তিনীয়দের জন্য তাদের সময় নেই। সিরিয়ার বাশার-আল-আসাদ জেহাদি গোষ্ঠী আবু বকর আল-বাগদাদির নেতৃত্বাধীন ইসলামি প্রজাতন্ত্রের যোদ্ধাদের দমন করতে হিমসিম। ইরাকের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডও তাদেরই দখলে, সিরিয়ার সঙ্গেই যারা ইরাককেও নতুন খিলাফত বলে ঘোষণা করেছে। লক্ষণীয়, এই জেহাদি জঙ্গিরা আবিশ্ব মুসলিমদের বাগদাদিকে খলিফা শিরোধার্য করার ফরমান জারি করে সামরিক আস্ফালনে দু-দুটো দেশ কাঁপাচ্ছে, কিন্তু গাজার প্যালেস্তিনীয়দের পাশে দাঁড়ায়নি। অন্য সব আরব দেশে খলিফাতন্ত্র কায়েম করার পরেই তারা ইজরায়েলের দিকে নজর দেবে, এমন ভাসা-ভাসা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক ইসলাম অতএব প্রথমাবধি দ্বিধা বা বহুধা বিভক্ত। মোয়াম্মার গদ্দাফি থাকলে হয়তো ইজরায়েলের বিরুদ্ধে কিছুটা হাঁকডাক করতেন, কিন্তু লিবিয়ায় স্বৈরতন্ত্র উৎখাত করে পশ্চিমী ধাঁচের গণতন্ত্র প্রবর্তনের উদ্যোগের পরিণামে সেখানেও আজ জেহাদি ইসলামপন্থীরাই মাৎস্যন্যায় চালাচ্ছে। বাকি রইল ইরান। ইরানের শীর্ষ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে গাজার প্যালেস্তিনীয়দের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান, সেই সঙ্গে আক্রান্ত প্যালেস্তিনীয়দের অস্ত্রসজ্জিত করার ডাকও।
তবে সকলকে ছাপিয়ে গেছেন তুরস্কের শাসক এর্দোগান। ইজরায়েলি আগ্রাসনকে তিনি হিটলারের নাতসি বর্বরতার চেয়েও নিকৃষ্ট আখ্যা দিয়েছেন। এর্দোগান কামাল আতাতুর্কের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী নন, এক ধরনের নরম মৌলবাদ অনুশীলন করে ধাপে-ধাপে স্বদেশকে আরব দুনিয়ার সঙ্গে একাত্ম করতে চান। তিনি বুঝে গেছেন, ইউরোপ তুরস্ককে কোল দেবে না, তাই আরব দুনিয়ায় কেউকেটা হতে পারলে আখেরে ইউরোপের কাছেও গুরুত্ব মিলতে পারে। আর আরব বিশ্বে প্রাধান্য পেতে হলে জায়নবাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে হয়। সেই রীতি মেনেই এর্দোগান নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়ছেন।
আরব বসন্তের বৃত্ত অতএব সম্পূর্ণ। মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতে ইজরায়েলকে মুর্দাবাদ এবং প্যালেস্তিনীয়দের জিন্দাবাদ দিয়ে বের হওয়া মিছিলগুলো পত্রপাঠ পুলিশি দমনে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হচ্ছে। ইজরায়েল একদা আরব বসন্তের দখিনা বাতাসকে ভয় পেয়েছিল, যেমন পেয়েছিল আরব দেশগুলির স্বৈরশাসকরা। আজ গাজা প্রশ্নে উভয় পক্ষের যে ঐক্য, তাতে আগ্রাসন বন্ধ করতে বলা রাষ্ট্রপুঞ্জ, এমনকী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও তুলনায় হামাস-সমর্থক মনে হচ্ছে। তবে শীতের মতো বসন্তও ঘুরে ঘুরে আসে। কখনও কখনও তা দখিনা বাতাসের পরিবর্তে বজ্রনির্ঘোষেও আছড়ে পড়ে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy