Advertisement
E-Paper

ব্যক্তি সত্য

আজ অপরাহ্ণেই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বের সমাপ্তি। অনেকেই হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিবেন। ব্যক্তিগত আক্রমণের যে বাহুল্য ভারত গত দেড় মাস যাবৎ প্রত্যক্ষ করিয়াছে, তাহা অনেকের নিকটই অসহ ঠেকিয়াছে। স্মৃতি সততই ক্ষণস্থায়ী। নচেৎ, এই ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রবণতা যে ভারতীয় রাজনীতির একটি বহুচর্চিত পথ, তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইত না। নীতিগত প্রশ্ন ছাড়িয়া, রাজনৈতিক বিরোধের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া ব্যক্তিকে তাহার ব্যক্তিগত পরিসরের কোনও প্রকৃত বা কাল্পনিক দুর্বলতা বা খামতি লইয়া আক্রমণ করা কেন? ভারতীয় রাজনীতিতেই এই প্রশ্নের উত্তর রহিয়াছে। এই দেশে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ রাখিলে, রাজনীতিতে ব্যক্তিই মুখ্য।

শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৪ ০০:১২

আজ অপরাহ্ণেই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বের সমাপ্তি। অনেকেই হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিবেন। ব্যক্তিগত আক্রমণের যে বাহুল্য ভারত গত দেড় মাস যাবৎ প্রত্যক্ষ করিয়াছে, তাহা অনেকের নিকটই অসহ ঠেকিয়াছে। স্মৃতি সততই ক্ষণস্থায়ী। নচেৎ, এই ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রবণতা যে ভারতীয় রাজনীতির একটি বহুচর্চিত পথ, তাহা বুঝিতে বিলম্ব হইত না। নীতিগত প্রশ্ন ছাড়িয়া, রাজনৈতিক বিরোধের গণ্ডি অতিক্রম করিয়া ব্যক্তিকে তাহার ব্যক্তিগত পরিসরের কোনও প্রকৃত বা কাল্পনিক দুর্বলতা বা খামতি লইয়া আক্রমণ করা কেন? ভারতীয় রাজনীতিতেই এই প্রশ্নের উত্তর রহিয়াছে। এই দেশে, কিছু ব্যতিক্রম বাদ রাখিলে, রাজনীতিতে ব্যক্তিই মুখ্য। দল নহে। আজ যেমন ভারতীয় জনতা পার্টি প্রকৃত প্রস্তাবে নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁহার দলে পরিণত হইয়াছে, সত্তরের দশকে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসও ইন্দিরা গাঁধীর দল বই কিছু ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী বা মুলায়ম সিংহ যাদবকে সরাইয়া রাখিলে তাঁহাদের দলগুলির কয় সহস্রাংশ অবশিষ্ট থাকে? বস্তুত, অনেক ক্ষেত্রেই দল এবং নেতার মধ্যে বিভেদরেখাটি ক্ষীণ হইতে হইতে প্রায় মিলাইয়া গিয়াছে। কাজেই, বিরোধী পক্ষ যখন আক্রমণ শানায়, তাহার নিশানায় দলের তুলনায় নেতা বেশি আসেন, আশ্চর্য কী?

তাহাতে অস্বাভাবিকতাই বা কোথায়? দলের ঊর্ধ্বে যে ব্যক্তি, গণপরিসরে তাঁহার নির্মাণ তো কেবল তাঁহার রাজনীতির মাধ্যমে, গণপরিচয়ের মাধ্যমে হয় না। তাঁহার ব্যক্তিগত জীবন সেই নির্মাণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী সম্ভবত তাহার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তাঁহার ব্যক্তিগত জীবনের প্রায় প্রতিটি উপাদান তাঁহার ‘মহাত্মা’ পরিচয় নির্মাণে ব্যবহৃত হইয়াছিল। বস্তুত, নেতার ব্যক্তিগত জীবন কী ভাবে তাঁহার রাজনৈতিক গ্রহণেযোগ্যতা বাড়ায়, ঘরের কাছেই তাহার বহু উদাহরণ আছে। প্রফুল্ল সেন হইতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নেতাদের ব্যক্তিগত জীবনের আড়ম্বরহীনতা, ‘সাধারণ’ যাপন তাঁহাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের সহায়ক হইয়াছে। নরেন্দ্র মোদীর যে বাল্য-জীবনী প্রকাশিত হইয়াছে, নিতান্ত ব্যক্তিগত পরিসরের সেই কল্প-বাস্তবও তাঁহার ভাবমূর্তি নির্মাণেরই হাতিয়ার। কাজেই, ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক, এই দুইটি পরিচয়কে পৃথক করা মুশকিল। অতএব, যে রাজনীতিতে ব্যক্তিই মুখ্য, এবং যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিচয়ের মধ্যে বিভাজিকা নির্মাণ প্রায় অসম্ভব, সেই রাজনীতিতে ব্যক্তি আক্রমণ নিতান্ত স্বাভাবিক।

এক বার ব্যক্তিগত আক্রমণকে ‘স্বাভাবিক’ বলিয়া মানিলে কি কোথাও তাহার রাশ টানা সম্ভব? না কি, শিষ্টাচারের সমস্ত গণ্ডি অতিক্রম করিয়া কোনও এক অকল্পনীয় অতলে পৌঁছাইয়া তবে তাহা থামিবে? ভারতের সামাজিক পরিসর হইতে সাম্প্রতিক অতীতে শিষ্টাচার কার্যত বিদায় লইয়াছে বলিয়া প্রশ্নটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। সভ্য মানুষের জীবনে সৌজন্য বোধটি অত্যাগসহন হওয়া বিধেয়। কথাটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রমণের ক্ষেত্রে নহে, রাজনীতির সর্বস্তরের পক্ষে প্রযোজ্য। একদা অতুল্য ঘোষকে বামপন্থীরা যে কারণে এবং যে ভাষায় আক্রমণ করিতেন, তাহা শালীনতার সীমার অপর পারে। মহেন্দ্র সিংহ টিকায়ত মায়াবতীর বিরুদ্ধে যে বাক্যবাণটি ছুড়িয়া বেজায় বিপাকে পড়িয়াছিলেন, তাহাও এই গোত্রের। এই আক্রমণগুলি সৌজন্য ও বিবেচনা বোধের অভাবপ্রসূত। তাহা অবশ্যই পরিহার্য। কিন্তু তাহার বাহিরে যে আক্রমণ, কিঞ্চিৎ লবণ সহযোগে তাহার স্বাদ গ্রহণ করিতে ক্ষতি কী? রাজনীতি হইতে কৌতুক, তির্যকতা, এবং খানিক নষ্টামি বিদায় লইলে রাজনীতি বস্তুটি বিবর্ণ হইয়া যাইবে না কি?

editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy