Advertisement
১৬ জুন ২০২৪
প্রবন্ধ ২

শিশুদের জন্য সরকার কতটুকু করতে চায়

নতুন সরকার বলেছে, তরুণ প্রজন্ম আর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ওপর তারা জোর দিতে চায়। কিন্তু বাজেটে শিশুদের জন্য যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে, সরকারের সামনে পরিষ্কার রাস্তা নেই। লিখছেন কোমল গনোত্রাভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে বিভিন্ন খাতে যে সমস্ত ব্যয়বরাদ্দ শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়, ২০০০-০১ সালে তার অনুপাত ছিল মোট সরকারি বাজেটের ২.৩৯ শতাংশ। সেখান থেকে এই বরাদ্দ ২০১৩-১৪ সালে ৪.৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে।

শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে বিভিন্ন খাতে যে সমস্ত ব্যয়বরাদ্দ শিশুদের জন্য ব্যবহৃত হয়, ২০০০-০১ সালে তার অনুপাত ছিল মোট সরকারি বাজেটের ২.৩৯ শতাংশ। সেখান থেকে এই বরাদ্দ ২০১৩-১৪ সালে ৪.৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে গত পাঁচ বছরে শিশুদের জন্য বাজেটে বরাদ্দের অনুপাত প্রায় একই জায়গায় আটকে রয়েছে। নতুন সরকারের জমানায় এই অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে কি?

ভারত গড়ে তোলার আশ্বাস দিয়ে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন অর্থমন্ত্রীর বাজেট নিয়ে একটা বড় আশা তৈরি হয়েছিল। এই সরকার বলেছে, তরুণ প্রজন্ম আর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার ওপর তারা বিশেষ জোর দিতে চায়। এ বছর সাধারণ লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি যে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছিল তাতে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়ে বিশেষ আশ্বাস ছিল। যেমন, উন্নত মানের শিক্ষা, অপুষ্টি দূরীকরণ, চিকিৎসার খরচ কমানো, শিশু শ্রম আইন সংশোধন। এবং, অল্প হলেও, শিশু সুরক্ষার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু এ বারের বাজেটে শিশুদের জন্য যে সব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তা দেখে মনে হচ্ছে যে, সরকারের সামনে খুব পরিষ্কার কোনও রাস্তা নেই। ২০১৪-১৫ সালে শিশুদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট সরকারি ব্যয়ের ৪.৫২ শতাংশ, আগের বছরের বাজেটে যা ছিল ৪.৫৬ শতাংশ। ভারতের জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ শিশু (আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত)। এই ৪২ শতাংশের জন্য বরাদ্দ ব্যয় মোট জাতীয় আয়ের মাত্র ০.৬৩ শতাংশ।

শিশুদের জন্য যে সব প্রকল্প রয়েছে, সেগুলোকে মোটামুটি চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে ভাগ করা যায়: শিক্ষা, উন্নয়ন, স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা। শিশুশিক্ষা সম্পকির্ত প্রকল্পগুলি কেবল মাধ্যমিক স্তর পর্যন্তই সহায়তা দেয়, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য কোনও প্রকল্প নেই। শিশু উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত প্রকল্পগুলি বাচ্চাদের পুষ্টি আর দেখভাল করার কথা বলেছে। আর শিশু সুরক্ষার প্রকল্পে খুব কঠিন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলা রয়েছে।

২০১৪-১৫ সালে বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ অর্থের ৭২.৩ শতাংশ রাখা হয়েছে শিশুদের শিক্ষার জন্য আর শিশু উন্নয়নের জন্য ২৩.১ শতাংশ। শিশুস্বাস্থ্য ও শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছে যথাক্রমে ৩.৫ শতাংশ ও ১.১ শতাংশ। অর্থাৎ, আগের মতোই, অন্যান্য খাতের তুলনায় শিশুশিক্ষার খাতে তুলনায় বেশি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, শিশুশিক্ষায় যথেষ্ট বরাদ্দ পাওয়া গেছে। সর্বশিক্ষা অভিযান প্রকল্পের বরাদ্দ বেড়েছে মাত্র ১৩৭৭ কোটি টাকা। নতুন প্রকল্পগুলির মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও বয়স্কদের শিক্ষা এবং মাদ্রাসা উন্নয়নের জন্য যথাক্রমে ১২৫০ কোটি টাকা এবং ২৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। দুটি প্রকল্পের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা উচিত। ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও যোজনা’। এই প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। আর দ্বিতীয়টি হল মেয়েদের স্কুলে খাবার জল আর বাথরুমের ব্যবস্থা করা।

শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় চল্লিশ শতাংশ। তবে এই বাজেটের সিংহভাগ, ২৬২২ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে প্রধানত চারটি খাতে: জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, জাতীয় নগর স্বাস্থ্য মিশন, প্রজনন ও শিশুস্বাস্থ্য প্রকল্প এবং বিধিবদ্ধ টিকাকরণ প্রকল্প। ফলে অন্যান্য খাতে বরাদ্দ অনেক কম। বাজেটে জাতীয় অপুষ্টি দূরীকরণ প্রকল্পটি একটু ভরসা দেয়। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে স্বীকার করেছেন যে, ভারতের প্রায় ৫০ শতাংশ শিশুই অপুষ্টিতে ভোগে। ভারতে শিশুস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা অনেক রকম। পাঁচ বছরের নীচে ৪৪ শতাংশ শিশুর ওজন কম এবং ৪৮ শতাংশ শিশুর যথেষ্ট শারীরিক বৃদ্ধি হয় না। অন্য দিক থেকে দেখলে, সারা পৃথিবীর কম-ওজনের বাচ্চাদের ৪২ শতাংশ ভারতের, এবং যে শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধি ঠিকঠাক নয় তাদের মধ্যে ৩১ শতাংশ এ দেশের। নতুন সরকারকে অবস্থা পালটানোর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।

শিশু সুরক্ষাও এই বাজেটে তেমন প্রাধান্য পায়নি। ২০১২-১৩ সালে সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্পটির (আইসিপিএস) জন্য বরাদ্দ ছিল ৪০০ কোটি টাকা, ২০১৩-১৪’য় তা কমে হয় ৩০০ কোটি টাকা। এ বার বরাদ্দ বেড়ে ফের হয়েছে ৪০০ কোটি। কিন্তু এই বর্ধিত পরিমাণও অত্যন্ত কম। এইটুকু টাকা দিয়ে শিশুশ্রমিক কিংবা কম বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া বা পাচার হয়ে যাওয়া যে মেয়েদের উদ্ধার করা যায়, তাদের নিরাপত্তা আর পুনর্বাসন কোনওটাই প্রায় সম্ভব নয়। যত বিরাট সংখ্যক শিশু নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে, এইটুকু বরাদ্দ টাকা দিয়ে তাদের জীবন ভাল করা যাবে না। শিশুদের যে একটা সুরক্ষিত জীবন দিতে হয়, সেই জরুরি ভাবনাটাই গড়ে তোলা যায়নি।

শিশুদের জন্য নতুন যে আইনগুলি গত কয়েক বছরে আনা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে অবৈতনিক এবং আবশ্যিক শিক্ষার অধিকার, ২০০৯ (আরটিই), যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার আইন ২০১২, জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩, শিশুদের জন্য জাতীয় আইন ২০১৩, খুব ছোট শিশুদের পরিচর্যা ও শিক্ষা সংক্রান্ত নীতি। এ ছাড়াও, জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, সুসংহত শিশু উন্নয়ন প্রকল্প, মিড ডে মিল, সর্বশিক্ষা অভিযান, সুসংহত শিশু সুরক্ষা প্রকল্প ইত্যাদির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই নীতিগুলি প্রণয়ন এবং প্রকল্পগুলির কাজ যাতে ঠিক মতো হতে পারে সে জন্য বাজেটে যথেষ্ট থাকা বরাদ্দ করা জরুরি। ভারত এখনও শিশুদের জন্য উন্নত মানের শিক্ষা, অবৈতনিক শিক্ষা, অপুষ্টি দূরীকরণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে নীরোগ এবং সুরক্ষিত একটি সমাজ গড়ে তুলতে পারেনি। উৎকৃষ্ট শিক্ষার প্রসারও দূর অস্ত্। আমরা কখনওই অস্বীকার করতে পারি না যে, বিশাল সংখ্যক শিশুর সুরক্ষা আর যত্ন প্রয়োজন। যত শিশু পাচার, লাঞ্ছনা এবং শিশু শ্রমের শিকার হচ্ছে, তাদের উন্নয়ন ও সুরক্ষার জন্য মাত্র কিছু টাকা বরাদ্দ করার যে মানসিকতা, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ভারতে শিশুরা সব সময়ই লিঙ্গবৈষম্য থেকে শুরু করে বেশি মাত্রায় অপুষ্টি, অনিয়মিত ও কম হারে টিকাকরণ, নানা রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে চলেছে। তা ছাড়া, পরিস্রুত জল ও স্যানিটেশনের অভাব, জন্মের নিয়মিত নথিভুক্তি না হওয়া, ঠিকঠাক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামো না পাওয়া ইত্যাদি কারণে সর্বাঙ্গীণ উন্নয়ন থেকে শিশুরা বঞ্চিত হয়। সরকারের উচিত, শিশুদের সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করে বাজেটের বরাদ্দ যথেষ্ট বাড়িয়ে নানা জরুরি নীতি ও প্রকল্প গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি যত্নশীল হওয়া।

ডিরেক্টর, পলিসি, রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি, ক্রাই (চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial komol ganetra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE