Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

শক্তিশালী ও জবরদস্ত নেতা মানেই কি সুযোগ্য

রাজাকে সত্‌ হতে হবে। অসত্য অন্যায়ের মাধ্যমে রাজধর্ম পালন হবে না। রাজা শক্তিশালী হবে না। বলেছিলেন কৌটিল্য। আর্চি ব্রাউনের লেখা বইয়ের প্রেক্ষিতে ভারতীয় রাজনীতিক ও নেতাদের অবস্থান নিয়ে কলম ধরলেন জয়ন্ত ঘোষালরাজাকে সত্‌ হতে হবে। অসত্য অন্যায়ের মাধ্যমে রাজধর্ম পালন হবে না। রাজা শক্তিশালী হবে না। বলেছিলেন কৌটিল্য। আর্চি ব্রাউনের লেখা বইয়ের প্রেক্ষিতে ভারতীয় রাজনীতিক ও নেতাদের অবস্থান নিয়ে কলম ধরলেন জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০০
Share: Save:

শক্তিশালী নেতা কাকে বলে?

আমরা সব সময়েই বলি দেশের স্বার্থে, রাজ্যের স্বার্থে দরকার জবরদস্ত প্রশাসক। স্ট্রং লিডার। কেউ কখনওই বলেন না, হোয়াট ইউ নিড ইজ উইক লিডার। শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রশংসার বিষয়, দুর্বলতা পরিত্যাগযোগ্য। কিন্তু কোন ব্যক্তি কতখানি শক্তিশালী আর কতখানি দুর্বল এটা দিয়েই কি বিচার করা হবে আদর্শ নেতার চরিত্র? যাঁরা ক্রীড়াজগতে বিখ্যাত ভারোত্তোলক বা কুস্তিগীর, তাঁরা তো দুর্বল চিত্ত নন। কিন্তু তাঁদের শক্তি অনেকটাই শারীরিক। আবার হিটলারের মতো ছোটখাটো মানুষের শক্তি ছিল মূলত মনস্তাত্ত্বিক। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর কত ইঞ্চি ছাতি, তাই দিয়েই কি বিচার হবে তিনি শক্তিশালী না দুর্বল নেতা?

সততা, বুদ্ধি, প্রকাশের ক্ষমতা, বিচারক্ষমতা, প্রশ্ন করার মন, মতামত বা নানান মতামত সংগ্রহের ইচ্ছা, তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা, ভাল স্মৃতিশক্তি, সাহস, দূরদর্শিতা, সীমাহীন উত্‌সাহ এবং চিন্তাভাবনায় কট্টর না হয়েও আধুনিক ও নমনীয় হওয়া— এ সবই কি ভাল নেতা হওয়ার গুণ নয়? আজকাল বার বার মনে হয়, শক্তিশালী, জবরদস্ত ও সুযোগ্য নেতা সম্পর্কে ভারতীয় মনে কিছু বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যা বাস্তব থেকে অনেকটাই দূরে।

সম্প্রতি আর্চি ব্রাউনের লেখা ৪৬৬ পৃষ্ঠার খুদে মহাভারত-সম একটি বই পড়লাম। বইটির নাম— দ্য মিথ অফ দ্য স্ট্রং লিডার/ পলিটিক্যাল লিডারশিপ ইন দ্য মডার্ন এজ। আর্চি ব্রাউন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক। বিগত পাঁচ দশক ধরে তিনি সোভিয়েত ও কমিউনিস্ট রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। ঠান্ডা যুদ্ধ ও আধুনিক নেতৃত্ব নিয়েও তাঁর বিস্তর গবেষণা রয়েছে।


অঙ্কণ: সুমিত্র বসাক।

এই সর্বশেষ গবেষণা গ্রন্থে তিনি দেখিয়েছেন, নেতার গ্ল্যামার, ক্যারিসমা, জনপ্রিয় জনমোহিনী শক্তি, যাই হোক না কেন আসলে নেতৃত্ব শক্তিশালী হতে পারে একমাত্র যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই। পুরোপুরি গণতন্ত্র আছে এমন দেশের পাশাপাশি যে সব দেশে গণতন্ত্রের প্রেক্ষাপট নেই সেখানেও কোনও ব্যক্তি প্রবল জনপ্রিয় স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠতে পারেন। ২০০৭ সালে উত্তর-কমিউনিজম ইউরোপের নানা দেশে অনুসন্ধান ও সমীক্ষা করে এ তথ্য পাওয়া গিয়েছে। আটটি দেশের মধ্যে তিনটে দেশের মানুষ সঙ্কট মোচনে স্বৈরতন্ত্রী শক্তিশালী শাসককে গ্রহণ করেছেন। আবার চেক গণতন্ত্রী রাষ্ট্রে বা স্লোভাকিয়াতে শক্তিশালী অগণতান্ত্রিক নেতার প্রতি মানুষের সন্দেহ সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে। ভারতে গণতান্ত্রিক নেতার আবরণ কম দেখা যায়। শুধু সর্বভারতীয় দল নয়, ভারতের আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে নেতা-নেত্রীরাও একাধারে জনপ্রিয় এবং অগণতান্ত্রিক হয়ে থাকেন। জয়ললিতার দলের একটি ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে। লালকৃষ্ণ আডবাণী তখন উপ-প্রধানমন্ত্রী। এআইডিএমকে তখন এনডিএ-র শরিক। আর জয়ললিতা তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী। আডবাণী তাঁর বাসভবনে আম্মা ও তাঁর দলীয় সাংসদদের প্রাতঃরাশ বৈঠকে ডাকেন। আসার আগে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে সংসদ সদস্যদের ফোন করে জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁরা কে কী খাবেন? তা শুনে সব সাংসদ হা হা করে ওঠেন ফোনে। সকলেরই একই কথা, আমাদের কোনও নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ নেই। আম্মা-র জন্য যা মেনু হবে আমরাও তাই খাব।

এর পর প্রাতঃরাশের ঘটনা। খেতে খেতে একটি তরকারি দেখে আম্মা জিজ্ঞাসা করলেন, আডবাণীজি এটা কী? বিজেপি নেতা বলেন, কমল কি ককরি। মানে পদ্মফুলের কাণ্ড দিয়ে তৈরি এক বিশেষ তরকারি। হঠাত্‌ আম্মা ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলে সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন— না, না। ব্যস, সমবেত ভাবে সাংসদেরা সেই তরকারির বাটি তত্‌ক্ষণাত্‌ সরিয়ে ফেললেন।

আর একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল তত্‌কালীন গোয়েন্দা প্রধান শ্যামল দত্তের। তিনি চেন্নাই গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে। গিয়ে দেখেন, এক বড় সভাগৃহে মুখ্যসচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব-সহ সংশ্লিষ্ট কিছু অফিসার সারিবদ্ধ হয়ে দণ্ডায়মান। কোনও চেয়ার পর্যন্ত নেই কারও বসার জন্য। এর পরে শঙ্খধ্বনি হল দূর থেকে। কেউ এক জন একটি বিশেষ রত্নখচিত সিংহাসন এনে রাখল মেঝেতে। তার পর ধীর গতিতে রাষ্ট্রপতি ভবনের কায়দায় আম্মা প্রবেশ করলেন। তিনি বসলেন এবং দণ্ডায়মান অফিসারদের সঙ্গে কথা বললেন। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। অনেকে বলেন, জয়ললিতার প্রথম জীবনটা খুবই কষ্টের। অত্যাচারিত-লাঞ্চিত হয়েছেন তিনি পুরুষশাসিত সমাজে। এমনকী, যে এমজিআর ছিলেন তাঁর নয়নের মণি, সেই মানুষটির সঙ্গেও তাঁর জীবনের শেষ অধ্যায়টি ছিল তিক্ততায় ভরা। সম্ভবত এই মনস্তাত্ত্বিক কারণে জয়ললিতা রাজনৈতিক ক্ষমতা পেয়ে এত স্বৈরতন্ত্রী হয়ে ওঠেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস ও সেনেটের ভূমিকা সংবিধানের মাধ্যমেই এমন ভাবে করা হয়েছে যাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে চরম ক্ষমতার ব্যবহার করা কঠিন। ক্লিন্টন থেকে ওবামা— প্রেসিডেন্টের কর্তৃত্বের অবক্ষয়ের নমুনা আমরা দেখছি। লিঙ্কন প্রায়ই বলতেন, কোনও ভুল হলে এটা আমাদের ভুল। ক্যাবিনেটের সকলের নয়। তাঁর মন্ত্রিসভার এক সতীর্থ সদস্য গিডিওন ওয়েলস বলেছেন, এ কথা বলার হিম্মত রাখতেন লিঙ্কন, তাই তিনি ছিলেন বড় নেতা। ম্যাক্স ওয়েরার একদা লিখেছিলেন, “a politician has to overcome a quite vulgar vanity, the deadly enemy of all matter of fact devotion to a cause and of distance forwards ones self.”

আর্চি ব্রাউন আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সেটি হল নির্বাচনে বিপুল ভাবে জিতলেই এক জন নেতা বা নেত্রী মনে করেন যে, তিনি যোগ্য, সফল এবং শক্তিশালী নেতা। কিন্তু সেটা এক মস্ত বড় ভুল। জয়লাভ করা মানেই কিন্তু ভাল নেতা হওয়া নয়। হিটলারও তাঁর জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রী দলের পক্ষে পেয়েছিলেন এক বিপুল জনসমর্থন। তাই খুব কম আসন পেয়েও চন্দ্রশেখর ভাল প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। আবার ২৮২টি আসন পেয়েও নরেন্দ্র মোদী সফল বা শক্তিশালী নেতা না-ও হতে পারেন।

তার মানে কিন্তু আমি বলছি না নরেন্দ্র মোদী শক্তিশালী, সফল নেতা নন। গত দশ বছরের নীতিপঙ্গুতার পর তাঁর চনমনে অতি-সক্রিয়তা প্রশংসনীয়, আন্তরিক ইচ্ছাও আছে এ দেশের উন্নয়নের অভিমুখ বদলানোর। প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের মতো এক বিশাল দেশে তা সম্ভব হবে কি হবে না। তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু দিন ধৈর্য্য ধরতে হবে। পাঁচ বছর পর মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষকেরা আর আত্মহত্যা করবেন না, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দারিদ্র বিচ্ছিন্নতা ও সন্ত্রাস থাকবে না, এ সব ভাবতে কষ্ট হয়, কিন্তু তা বলে চলার শুরুতে ‘সিনিক’-ই বা হব কেন?

ম্যাকিয়াভেলি তাঁর ‘প্রিন্স’য়ে বলেছিলেন, রাজাকে মিথ্যা বলতেই হবে, তাঁকে অভিনয় করে হলেও দেখাতে হবে যে তিনি প্রজাবত্‌সল। প্রজাদের শোকে তিনি মুহ্যমান, এই ধারণা রাজাকে জনপ্রিয় করবে।

কৌটিল্যের কূটনীতির ভারতীয় ঐতিহ্যের কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপট। চাণক্যের সূত্রতে নৈতিকতার কথা বলা হয়েছে বার বার। তাঁর সূত্রের প্রথমেই বলা হয়েছে, রাজাকে সত্‌ হতে হবে। অসত্য অন্যায়ের মাধ্যমে রাজধর্ম পালন হবে না। রাজা শক্তিশালী হবে না।

কংগ্রেস বনাম বিজেপি— এই ক্ষুদ্র রাজনীতির সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, ‘প্রেজুডিসড’ মনকে দূরে রেখে আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে চাই। দেশ চালনাটা কিন্তু ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা নয়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sahi jayanta ghoshal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE