Advertisement
E-Paper

সাদা-কালো গল্প

কালো মানুষ হিসেবে গর্বিত হতে গেলে ঘৃণা করতেই হবে শ্বেতাঙ্গদের, এই নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে এলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ বিদুষী।নিজের পরিবারের ইতিহাস খুঁজতে বেরিয়েছিলেন বার্টিস বেরি। সে বড় সহজ কাজ নয়। জীবনের প্রথম ত্রিশটা বছর এই কৃষ্ণাঙ্গী মার্কিন মহিলা জানতেন না, তাঁর বাবা কে। মায়ের সাতটি সন্তান, তাদের সাত জন বাবা। কারও সঙ্গেই সম্পর্ক রাখেননি মা। সাত সন্তানের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করতে যে পরিশ্রম হত শরীরে-মনে, সন্ধেবেলা আকণ্ঠ মদ্যপান করে হয়তো ভোলার চেষ্টা করতেন সেই যন্ত্রণা। অথবা, আরও বেশি কিছু, আরও কোনও অতীতের ক্ষত।

অমিতাভ গুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০১৪ ০০:১০

নিজের পরিবারের ইতিহাস খুঁজতে বেরিয়েছিলেন বার্টিস বেরি। সে বড় সহজ কাজ নয়। জীবনের প্রথম ত্রিশটা বছর এই কৃষ্ণাঙ্গী মার্কিন মহিলা জানতেন না, তাঁর বাবা কে। মায়ের সাতটি সন্তান, তাদের সাত জন বাবা। কারও সঙ্গেই সম্পর্ক রাখেননি মা। সাত সন্তানের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করতে যে পরিশ্রম হত শরীরে-মনে, সন্ধেবেলা আকণ্ঠ মদ্যপান করে হয়তো ভোলার চেষ্টা করতেন সেই যন্ত্রণা। অথবা, আরও বেশি কিছু, আরও কোনও অতীতের ক্ষত। মদ্যপ অবস্থায় ছেলেমেয়েদের মারধোর করতেন, গালি দিতেন নাহক। ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালানোর কাঠ কেনার মতো পয়সাটুকুও না থাকলে বাড়ির আসবাবগুলোই জ্বলত। সেই শৈশব থেকে উঠে এসে সমাজতত্ত্বে পিএইচ ডি করেছিলেন বার্টিস। বই লিখেছেন একের পর এক। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের ইতিহাস, বিশেষত অন্তরঙ্গ ইতিহাস, জানতে তাঁর আগ্রহ অসীম।

গত শতকের ষাট-সত্তরের দশকে আমেরিকায় আর পাঁচটা কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের মতোই বার্টিসদের পরিবারের ইতিহাসও দাসপ্রথার রক্তাক্ত পথ বেয়ে এসেছে। শ্বেতাঙ্গ প্রভুরা তাঁদের আফ্রিকান-আমেরিকান ক্রীতদাসদের মানুষ বলে মনে করতেন না, তা বিচিত্র নয়। রাষ্ট্রও মনে করত না। আদমসুমারি হলে বহু দিন অবধি সত্যিই এই কৃষ্ণাঙ্গদের মাথা কেউ গুনত না। ফলে, তাঁদের সম্বন্ধে তথ্য পাওয়ার রাস্তাও বন্ধ। ক্রীতদাসের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার পূর্ণ অধিকার মালিকের ছিল। পারিবারিক যে সূত্রে আমরা আজন্ম অভ্যস্ত, কালো পরিবারে তা ছিন্ন হত হামেশাই।

বার্টিস বেরির জন্ম ১৯৬০ সালে। আমেরিকায় সিভিল রাইটস মুভমেন্ট তখন মধ্যগগনে। তাঁর বড় হয়ে ওঠার বছরগুলো কালো মানুষদের জীবনে এক মোড় ঘোরার সময়। কালো হওয়ার মধ্যে যে কোনও লজ্জা নেই, বরং গর্ব করা যায় তা নিয়ে, এই বোধটা চারিয়ে যাচ্ছিল সবার মধ্যে। এই প্রথম বার। আর, যে কোনও গর্বেই যেমন হয়, কালো হওয়ার গর্বেরও উল্টো দিকে ছিল ঘৃণা— সাদা মানুষের প্রতি ঘৃণা। বার্টিস লিখেছেন, স্কুলবেলায় সবচেয়ে বড় ভয় ছিল, কেউ যদি বলে তুমি যথেষ্ট কালো নও! শুধু চামড়ার রঙে নয়, মনের রঙে। কালো হিসেবে গর্বিত হওয়ার শর্তই ছিল সাদাদের জন্য মনের দরজা বন্ধ রাখা।

এরই মধ্যে বার্টিসের মদ্যপ মা তাকে নিজের পরিবারের গল্প শোনাতেন। পরিবার বলতে, দাদামশাই আর দিদিমা। তাঁদের কাছেই বড় হয়েছিলেন বার্টিসের মা। বলতেন, দাদামশাই জন হেনরি ফ্রিম্যান নাকি ক্রীতদাস ছিলেন না। তিনি যে শ্বেতাঙ্গর খামারে কাজ করতেন, সেই জন হান নাকি তাঁকে ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে নিয়োগ করেছিলেন কর্মচারী হিসেবে। মিশতেনও নাকি প্রায় সমানে-সমানে। মায়ের গল্পে বারে বারেই ফিরে আসত এই জন হানের কথা। বার্টিস বিশ্বাস করতেন না তার একটি বর্ণও। শ্বেতাঙ্গ মালিক নাকি বন্ধুর মতো মিশত! বার্টিস নিশ্চিত ছিলেন, তাঁর মা আসলে ক্ষতবিক্ষত অতীতকে ঢেকে রাখতে চান তাঁর কাছ থেকে। হয়তো নিজের কাছ থেকেও। ৪০ বছর বয়সে পৌঁছে নিজের প্রথম উপন্যাসটি লিখলেন বার্টিস। সেই উপন্যাসের খলনায়ক এক শ্বেতাঙ্গ। ক্রীতদাসের মালিক। অত্যাচারী, নিষ্ঠুর, পাশবিক। বার্টিস সেই চরিত্রটির নাম রাখলেন জন হান। এটা তাঁর প্রতিশোধ। মা যাকে দেখাতে চান কালো মানুষের বন্ধু হিসেবে, তার আসল পরিচয় যে বার্টিস জানেন, সেটা জানিয়ে রাখা গেল। আর, এক অর্থে জন হানের নামটাকেও অত্যাচারী অতীতের সঙ্গে গেঁথে রাখা গেল ছাপা অক্ষরের অনপনেয় পেরেকে।

সেই বই ছেপে বেরোনোর বেশ কয়েক বছর পরে টেলিভিশনের এক অনুষ্ঠানে বার্টিস ক্রীতদাস প্রথার বিলুপ্তির নায়কদের তালিকায় শুনলেন জন হানের নাম। সেই জন হান, যাঁর খামারে কাজ করতেন বার্টিসের মায়ের দাদামশাই? সে রকমই মনে হল। শুরু হল বার্টিসের খোঁজ।

খোঁজ? নাকি এক অভিযাত্রা? আশৈশব যে বিদ্বেষ মনের ভিতর পোষণ করে বড় হয়েছেন বার্টিস আর তাঁর প্রজন্মের কালো আমেরিকানরা, সেই বিদ্বেষের আস্তরণ সরিয়ে প্রকৃত ইতিহাসের দিকে অভিযাত্রা? একের পর এক নথি ঘাঁটতে থাকেন বার্টিস। আর, তাতে বেরিয়ে আসে অবিশ্বাস্য সব তথ্য। সত্যিই কালো মানুষদের পক্ষে জান কবুল করে লড়েছিলেন জন হান। সত্যিই তিনি তৎকালীন আইনকে অবজ্ঞা করে একের পর এক পলাতক কালো মানুষের পরিবারকে ডেলাওয়ারের সীমানা পেরিয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন ফিলাডেলফিয়ায়, যেখানে ক্রীতদাস প্রথা আইনত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। সত্যিই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন জন হান। আদালতে বিচার হয়েছিল, দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন তিনি। আর, শাস্তি হিসেবে খোয়াতে হয়েছিল তাঁর সমস্ত সম্পত্তি। অন্য রাজ্যে গিয়ে ফের অর্থোপার্জন করেন তিনি। ফিরে আসেন ডেলাওয়ারে। যে আদালত তাঁকে দোষী ঘোষণা করেছিল, সেখানেই বিচারক পদে নিযুক্ত হন তাঁর ছেলে। ডেলাওয়ারে ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর রায়টি তাঁরই দেওয়া। এবং, সত্যিই বার্টিসের মায়ের দাদামশাইকে ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন জন হান। সেই মুক্তির প্রতীক হিসেবেই সেই কালো মানুষটি, জন হেনরি, নিজের নামে জুড়ে নেন ‘ফ্রিম্যান’ শব্দটি। ‘মুক্ত মানব’। কালো মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে জন হান আর জন ফ্রিম্যান সত্যিই সহযোদ্ধা ছিলেন।

জন হানকে ‘খুঁজে পাওয়া’-র এই উপাখ্যান নিজেই লিখেছেন বার্টিস। তাঁর ‘দ্য টাইজ দ্যাট বাইন্ড’ বইয়ে। কেন লিখলেন, সে কথাও বলেছেন তিনি। বাস্তবকে যে আসলে কখনও সাদা-কালো’র দ্বিমাত্রিক ছবিতে পাওয়া যায় না, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এই কথাটা আরও এক বার শিখেছিলেন বার্টিস। তবে, এই গল্পটা শুধু কালো মানুষের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এক শ্বেতাঙ্গকে পুনরাবিষ্কারের গল্প হয়ে থেমে থাকে না বোধ হয়। এটাও একটা বড় লড়াইয়ের গল্প। নিজের সঙ্গে, নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প। সাদারা যে সততই ঘৃণ্য, এ কথা তো শুধু পরিপার্শ্ব থেকে শেখেননি বার্টিস। তাঁর মা যেমন কালো হওয়ার কারণেই ধর্ষিত হয়েছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে, লোকের বাড়িতে ঝি-র কাজ করতে গিয়ে, তেমনই বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ ডি স্কলার বার্টিসও ধর্ষিত হয়েছিলেন। কালো বলেই জীবন থেকে অনেক প্রত্যাশা মুছে ফেলতে হয়, আশৈশব শিখেছেন বার্টিস।

সেই বার্টিসই খুঁজে বার করেন জন হানের ইতিহাস। নিজে স্বীকার করে নেন, তাঁর আগের বিচার ভুল ছিল। স্বীকার করেন, এক ভ্রান্ত বিশ্বাস তাঁকে মায়ের কাছে শোনা জন হানের গল্পকে সত্যি বলে মেনে নিতে দেয়নি। বার্টিস স্বীকার করে নেন, উপন্যাসে অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গ চরিত্রটিকে জন হানের নাম দেওয়া তাঁর একবগ্গা মনের দোষ।

এর কোনওটাই স্বীকার না করলেও চলত বার্টিসের। নিজের কাছে স্বীকার না করলেও চলত। বদলে, তিনি বই লিখে জানাতে চেয়েছেন নিজের ভুলের কথা। জন হানকে খুঁজে পাওয়ার অভিযাত্রা সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত।

ভাবি, আমরাও কি কখনও শিখব, এ ভাবে নিজের ভুল স্বীকার করে তাকে শুধরে নিতে?

amitabh gupta amitabh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy