Advertisement
১৬ জুন ২০২৪
প্রবন্ধ ২

স্বেচ্ছামৃত্যু: প্রশ্নটা উঠছে, উঠবেই

চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে রোগীর নিরাময় অসাধ্য, তার নিষ্কৃতি-মৃত্যুর দাবিকেও সমান মর্যাদা আর সহানুভূতি দিয়ে বিচার করা উচিত। দেবাঞ্জন সেনগুপ্তগত কয়েক দশক ধরে ভারতে নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে আলোচনা বার বার এক কোর্ট থেকে অপর কোর্টে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ বলল: বাঁচার অধিকার স্বীকার করা মানেই মৃত্যুর অধিকার স্বীকার করা নয়, নিষ্কৃতি-মৃত্যু চালু করতে চাইলে তাই আইনসভাকে আইন সংশোধন করতে হবে।

তর্ক থাকবেই। নিষ্কৃতি-মৃত্যুর বিরুদ্ধে মিছিল। প্যারিস, ২০১৪।  ছবি: এএফপি।

তর্ক থাকবেই। নিষ্কৃতি-মৃত্যুর বিরুদ্ধে মিছিল। প্যারিস, ২০১৪। ছবি: এএফপি।

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

গত কয়েক দশক ধরে ভারতে নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে আলোচনা বার বার এক কোর্ট থেকে অপর কোর্টে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ১৯৯৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ বলল: বাঁচার অধিকার স্বীকার করা মানেই মৃত্যুর অধিকার স্বীকার করা নয়, নিষ্কৃতি-মৃত্যু চালু করতে চাইলে তাই আইনসভাকে আইন সংশোধন করতে হবে। তারই প্রাথমিক ধাপ হিসেবে ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিষ্কৃতি-মৃত্যু সংক্রান্ত কিছু নির্দেশিকা দিল, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিষ্কৃতির এক নির্দিষ্ট বিভাজন করল। সম্প্রতি সর্বোচ্চ আদালত আরও সক্রিয় হয়ে আইনসভাকে এই উদ্যোগে শামিল করার প্রয়াসী হয়েছে। প্রধান বিচারপতি লোঢার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ দেশের সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিকে আট সপ্তাহের মধ্যে মতা জানাতে নোটিশ জারি করেছে।

এ এক ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু তার মানে কখনওই এই নয় যে, নিকট ভবিষ্যতে এক সমাধানসূত্র পাওয়া যাবে, এমন ভরসা করা যাচ্ছে। কারণ, এই বিষয়ে আইনি সায় জানানো যে দুরূহ, তা শুধু এ দেশের নয়, গোটা পৃথিবীর অভিজ্ঞতাতেই মালুম।

দুরূহ, কারণ প্রেক্ষাপট যা-ই থাক, এখানে নিরপরাধ মানুষের প্রাণ নেওয়ার আইনি বৈধতা চাওয়া হচ্ছে। বহু দেশের ঐতিহ্য-ধর্ম-সংস্কার এমন প্রয়াসকে খোলাখুলি সমর্থন জানাবে না। যখনই আইনরক্ষকরা বলছেন, নৈতিকতা ও ধর্মকে বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে, তখনই ভয় হয়, এ সবই বহু কাল ধরে চলে আসা নিয়মকে আরও বহু দিন বজায় রাখার অজুহাত। কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধের প্রশ্ন। কিন্তু এখন সময় এসেছে যে পুরনো নিয়ম আর ব্যবস্থার পিছুটান থেকে বেরিয়ে এসে নিষ্কৃতি-মৃত্যুকে বিশেষ পরিস্থিতি হিসেবে বিচার করার। সে বিচার প্রাচীন পুঁথির শ্লোক আউড়ে নয়, বিজ্ঞানের বাস্তব ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে। নিষ্কৃতি-মৃত্যু কেন-কার-কী ভাবে দরকার, ইত্যাদি প্রশ্ন খুব গভীর ভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ করতে হবে।

এর মধ্যে ‘কেন’ প্রশ্নটির উত্তর আপাতভাবে সহজ। যে রোগীর ব্যাধি নিরাময়-অসাধ্য, দীর্ঘ রোগশয্যায় যিনি কার্যত জীবন্মৃত, তাঁর জন্য মৃত্যুর অনুমতি চাওয়া হচ্ছে। তবে একটা কথা স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার: ব্যয়বহুল চিকিৎসা করানোর সাধ্য না থাকায় আমাদের দেশের বহু মানুষ যে মারা যাচ্ছেন, বা ডাক্তারদের অভাবে বহু ভারতবাসী যে চিকিৎসার আদৌ কোনও সুযোগ পাচ্ছেন না, এমন মানবিক সমস্যাগুলি এই আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক। এখানে ‘নিরাময়-অসাধ্য’ বলতে সেই সব অসুস্থতার কথা বলা হচ্ছে, যেখানে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও কোনও দিশা খুঁজে পায়নি। যে রোগীকে বিজ্ঞান মানুষের মর্যাদায় বাঁচিয়ে রাখতে অপারগ, তাঁর ধুকপুকুনি টিকিয়ে রাখার এত আয়োজন কি অশোভন নয়?

কিন্তু বিতর্ক উঠছে। উঠবেও। তার কারণ, এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ‘কী ভাবে’ নিষ্কৃতি-মৃত্যু দেওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়ে নানা তাত্ত্বিক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। সাধারণ ভাবে, মারণ ওষুধ প্রয়োগে প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি অথবা কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে পরোক্ষ নিষ্কৃতি— পদ্ধতি যা-ই হোক, তার জন্য প্রয়োজন নির্ভরযোগ্য চিকিৎসক। তারও আগে চিকিৎসকদেরই নির্ধারণ করতে হবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অবস্থা যথার্থই নিরাময়-অসাধ্য কি না। কিন্তু কোনও দেশের চিকিৎসককুলই এখনও সমাজের কাছে এতটা প্রশ্নাতীত বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তা ছাড়া, নানা আইনি ঝামেলায় সব সময় বিব্রত আধুনিক ডাক্তাররাও তাঁদের হিপোক্রেটিক শপথ ভেঙে ‘মৃত্যুর নিদানপত্র’ লেখার দায় একক ভাবে নিতে রাজি নন। ফলে ডাক্তারদের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নিতে হবে আইন ও বিচার ব্যবস্থাকেও। সুপ্রিম কোর্ট তাই আপাতত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কোনও রোগীর পরোক্ষ নিষ্কৃতির ব্যাপারে তাঁর মেডিক্যাল বোর্ড এবং রাজ্য সরকার যৌথ ভাবে ছাড়পত্র দিলে হাইকোর্টের অনুমতি নিয়ে তা কার্যকর করা যাবে। অর্থাৎ, ভেন্টিলেশনে নেই কিন্তু সুস্থ হবে না এমন রোগীর প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতির সুযোগ তো আটকে রাখা হলই, পরোক্ষ নিষ্কৃতির সুযোগও পরিকল্পিত দীর্ঘসূত্রিতায় প্রায় অধরা রাখা হল।

কারণটা বোধগম্য। নিষ্কৃতি-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পিছনে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সায়ই যথেষ্ট নয়, যাচাই করতে হবে এ মৃত্যুতে কেউ অনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে কি না বা কারও অশুভ স্বার্থ জড়িত কি না। এখানেই আসছে সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন: কার নিষ্কৃতি? কার আবার, সেই জীবন্মৃত, নিরাময়-অযোগ্য রোগীর! কিন্তু সব আবেগ সরিয়ে আর এক বার ভাবুন তো! রোগীর তাঁর নিত্যযন্ত্রণা দেখে দেখে বিধ্বস্ত স্বজনদেরও কি নিষ্কৃতি নয়? অন্ধ্রপ্রদেশের মুমূর্ষু কিশোর বেঙ্কটেশের নিষ্কৃতি-মৃত্যুতে আদালত সায় দিলে আবেদনকারিণী তার মা সুজাতাও কি রোজকার মানসিক যাতনা থেকে নিষ্কৃতি পেতেন না? মুম্বইয়ে বছরের বছর ধরে জীবন্মৃত অরুণা শানবাগকে প্রত্যক্ষ নিষ্কৃতি দেওয়ার অর্থ কি তাঁর বন্ধু-পরিজনদেরও দীর্ঘকালীন কষ্ট থেকে নিষ্কৃতি দেওয়া নয়?

আর, দেশে প্রতি দিন কত শত মানুষ যে তাঁদের যাবতীয় সঞ্চয় নিঃশেষ করে বৃথাই ভেন্টিলেটরের ভাড়া গুনে চলেছেন, তাঁদের নিষ্কৃতি? আইনের অপব্যবহার করে কোনও রোগীর উত্তরসূরি যদি শঠতা করতে চায়, তাকে অবশ্যই আটকাতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের মানুষকে সুস্থ করে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না জেনেও চিকিৎসা ব্যবস্থা আর আইনের জাঁতাকলে পড়ে যে পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে ক্রমাগত দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে, তাকে নিষ্কৃতি দেওয়ার দায় কি রাষ্ট্র ক্রমাগত এড়িয়ে যেতে পারে?

জানি, নিষ্কৃতি-মৃত্যুর সংজ্ঞাকে এত বিস্তৃত করলে, তার আওতাকে এত প্রসারিত করতে চাইলে অস্বস্তি বাড়বে, সমাধান আরও দূরপ্রসারী হবে। কিন্তু তবু এ প্রশ্ন তুলতে হবে। উঠছেও। শুধু বাঁচার আকুতি নয়, প্রয়োজনে মৃত্যুর আকুতির প্রতিও সমান সহানুভূতিতে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। আইনপ্রণেতারা আর কত দিন স্বেচ্ছামৃত্যুর অধিকারের এই দাবিকে উপেক্ষা করবেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

post editorial debanjan sengupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE