এ বারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন যে ইতিহাসে পাকাপাকি স্থান পাইল, তাহার কৃতিত্ব কেবল আম আদমি পার্টিরই নয়। কংগ্রেসকেও এই কৃতিত্বের কিছু হিস্সা দিতে হইবে। আপ-এর ঐতিহাসিক জয়ের পাশাপাশি একই রকম অবিস্মরণীয় হইয়া রহিল কংগ্রেসের ঐতিহাসিক পরাজয়টিও। বিধানসভার সত্তরটি আসনে লড়িয়া একটিও না জিতিবার এই রেকর্ড একেবারে নূতন অভিজ্ঞতা, এমনকী গত কয়েক বৎসরের পতনশীল কংগ্রেসের পক্ষেও। সত্তর জনের মধ্যে বাষট্টি জন প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হইবার দৃষ্টান্ত সহসা দেখা যায় না। তদুপরি, কাল ও পাত্রের সহিত স্থানও যে একটি অতি গুরুতর বিচার্য বিষয়, এ বারের নির্বাচন তাহা প্রমাণ করিয়া দেয়। অন্য রাজ্যে কংগ্রেসের এই দুর্দশা ঘটিলে হয়তো তাহার অর্থ খানিক ভিন্ন হইত। কিন্তু রাজধানী দিল্লি-সংবলিত বিধানসভার স্থানমাহাত্ম্যই আলাদা। সেই মহাস্থানে জাতীয় কংগ্রেসের এই ধ্বংসচ্ছবি দেশের প্রতিটি কোণে গুঞ্জন-ঢেউ তুলিয়াছে। কে না জানে, নির্বাচনী রাজনীতির দুনিয়ায় গুঞ্জনের ভূমিকাও নেহাত অনুল্লেখযোগ্য নয়! সুতরাং, পনেরো বৎসর একাদিক্রমে দিল্লি শাসন করিবার পর একটি আসনও না পাইবার এই ঐতিহাসিক ফলাফল দেশময় কংগ্রেসকে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া দিল, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়।
নয় মাস আগে জাতীয় নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে কংগ্রেসের বিপুল হারকে অনেকেই মোদী-তরঙ্গের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করিয়াছিলেন। এ বারের অভিজ্ঞতা কিন্তু দেখাইয়া দিল যে, বিজেপি ধুলায় মিশিয়া গেলেও কংগ্রেসের বিন্দুমাত্র ভাগ্যোদয় না-ই হইতে পারে। সমস্ত অ-বিজেপি ভোট তৃতীয় দলে কেন্দ্রীভূত হইতে পারে। একই সঙ্গে, জনমুখী, পুনর্বণ্টন-ধর্মী, ‘ঝোলাওয়ালা’ রাজনীতিও যে আর কংগ্রেসের একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, বোঝা গেল। আপ-অ্যাজেন্ডাকে কিন্তু এই ঝোলাওয়ালা রাজনীতি দিয়াই ব্যাখ্যা করিতে হইবে। বস্তি-অঞ্চল, সংখ্যালঘু অঞ্চল, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠী, কংগ্রেসের চিরকালীন শক্তিকেন্দ্রগুলি অতি সহজেই কংগ্রেসের বিকল্পের নিকট আত্মসমর্পণ করিল। সুতরাং, বার্তাটি স্পষ্ট। কংগ্রেসকে যদি এখনও ঘুরিয়া দাঁড়াইতে হয়, তবে নূতন অর্থনীতি, নূতন রাজনীতির ধারা অনুযায়ী নিজেকে নূতন ভাবে আবিষ্কার করিতে হইবে।
একের পর এক বিপর্যয় সত্ত্বেও কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যে অবশ্য কোনও নূতন চিন্তার ইঙ্গিতও নাই। বাস্তবিক, কংগ্রেসের নির্বাচনী পরাজয় অপেক্ষা তাহার নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া, অর্থাৎ প্রতিক্রিয়ার সম্পূর্ণ অভাবটিই, অধিকতর বিস্ময়কর। একটি ঐতিহ্যবাহী দলে নূতন নীতি প্রণয়ন করিবার জন্য হয় পুরাতন নেতাদের নির্মম আত্মসমালোচনার সততা ও শক্তি দরকার, নতুবা দরকার, নূতন নেতাদের উত্থানের অবকাশ। কোনওটিই এই দলে নাই। সর্বভারতীয় সভাপতি ও কংগ্রেসের ‘রাজপুত্র’ রাহুল গাঁধীর ইমেজ ও আসন বাঁচানোই যদি দলের প্রধান অভীষ্ট হয়, এবং রাহুল গাঁধীর অভীষ্ট যদি হয়, আলস্য ও অদক্ষতার বিন্দুমাত্র সংশোধন ছাড়াই নিপাট রাজপুত্র-গিরি চালাইয়া যাওয়া, তবে সংশোধনের সম্ভাবনা এ বারের আসন-সংখ্যার সমতুল বলা চলে: শূন্য। অত্যধিক কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দল চালনার ফলে দলের শিরদাঁড়াটিই সমূলে ভাঙিয়াছে, কোনও যোগ্য নেতার সন্ধান মিলে না। আঞ্চলিক স্তরে দল-সংগঠনের নামে অকর্মণ্যতা ও চাটুকার-তন্ত্রের সাধনা হইতেছে, জনতার বিমুখতার মূল্যে। অথচ, দরকার ছিল বৃহত্তর জনপ্রতিনিধিত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মূলধন করিয়া বর্তমান সময়ের উপযোগী সংস্কারমুখী রাজনীতিতে ফিরিয়া যাওয়া, দলীয় সংগঠনকে নূতন রাজনৈতিক আদর্শে প্রতিস্থাপন। সাড়ে সাত দশকের পুরানো স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আঁকড়াইয়া রাজনীতি আর কত দিনই বা চলিতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy