‘রাত ভেঙে দিন হয়
ফসলের তরে কামনার
জেগে থাকা!’
মৃত, অর্ধমৃত, ধর্ষিত শবদেহ গুনতে গুনতে আর একটা ‘নারী দিবস’ দুয়ারে উপস্থিত। যখন কিশোরীবেলা, তখন মনে হত এ যেন এক সান্তাক্লজের আগমনী বার্তা। কিন্তু আজ ৪৫টি বসন্ত উদ্যাপিত মেদ-চর্বিতে পৃথুলা মন বোঝে যা অধিকারের বার্তা বহনকারী নীলকণ্ঠ হতে পারত, আমরা আজও তার নাগাল পাওয়ার তাগিদ রপ্ত করতে পারিনি। ব্যক্তির লড়াই আমাদের অনুরণিত করতে পারে, কিন্তু অনুপ্রাণিত করতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। তার কারণ অনুসন্ধানেও আমরা অনুৎসাহী! ফলে রাষ্ট্রশক্তির অঙ্গুলিসঙ্কেতে শুরু হয়েছে পাশাখেলা! আবার শুরু হয়েছে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। সমাজে আজ অকৃত্রিম, শর্তহীন বন্ধুত্বের প্রতীক কেশব আজ অনুপস্থিত। দলীয় তন্ত্রে বিকিয়ে যাওয়া জনমন কি শর্তহীন বন্ধুত্বের প্রতীক হতে পারে? সমাজ ১৫, ১২, ১০ থেকে এখন ৩ বছরের শিশু শরীরেও যৌন গন্ধ খুঁজছে! রেচনতন্ত্র আর জনন তন্ত্রের সীমানা ভাঙছে প্রায় প্রতিদিন! টাকার তুল্যমূল্যে রাষ্ট্র কিনছে ধর্ষিত যোনি এবং ধর্ষকের নিরাপত্তা। এর মাঝে ‘নারী দিবস’ খাবি খাচ্ছে কি?
সবই কি নিস্ফলা? নাকি অস্ত্রের ধার বাড়ছে?
ইতিহাস বলে, সভ্যতার ঋণ শোধ করতেই হবে! ‘রাত ভেঙে দিন হয়/ ফসলের তরে কামনার জেগে থাকা!’
২০২৪ সালের ৮ অগস্ট আরজি কর-কাণ্ডে এক প্রাণের অপমৃত্যুকে কেন্দ্র করে গঙ্গার এপারের একদল কিশোরী যখন তাদের বড়দিকে পথে নামার বিধান দেন, তখন উপোসী বহু মন এক চিলতে আশায় বুক বাঁধে এটা ভেবে যে ‘সবটাই মিথ্যে নয়/ কিছু ইতিহাস এখনও লেখা বাকি’।
আমাদের স্কুলটি একটি নির্দিষ্ট লিঙ্গের মানুষের জন্য, মেয়েদের জন্য। তাই স্কুলের নামেও রয়েছে ‘বালিকা’ বিদ্যালয়। কিন্তু ছোট থেকেই শিশুমনে লিঙ্গভেদ নির্দিষ্ট ভাবে গেঁথে দেওয়ার ভাবনার বিপক্ষে আমি। তাই আমার স্কুলে সুপ্রভাত বলার পরে ‘মেয়েরা’ না বলে ‘বাচ্চারা’ বলে অভিহিত করা হয়। আমরা ছোট বয়স থেকেই ওদের গলাটা ছাড়তে বলি। স্পষ্ট ভাবে নিজের বক্তব্য বা অভিমত তুলে ধরার অভ্যেস তৈরি করার চেষ্টা করি। ওদের শরীর এবং মন নিয়ে সরাসরি কথা বলতে উৎসাহ দেওয়া হয়। বয়ঃসন্ধির সময়ে নানারকম মানসিক টানাপড়েন চলে বাচ্চাদের মনে। যেখানে মনের অসুখ নিয়ে অভিভাবকদের মনেই তো নানারকম ‘ট্যাবু’, সেখানে বাচ্চারা এই সময় আরও কুঁকড়ে যায়! আমরা তাই ‘মনের কথা বলি’ নামক একটি কাউন্টার তৈরি করেছি স্কুলে। যেখানে আমার বাচ্চারা না বলা কথা লিখে জানায়।
এ ছাড়া, বাচ্চাদের শরীর সম্পর্কে পরিবারের থেকে চাপিয়ে দেওয়া ‘ট্যাবু’গুলি নিয়েও ওদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজন পড়লে চিকিৎসকদের সাহায্যও নেওয়া হয়। এমনকি বাচ্চাদের সঙ্গে সারভাইক্যাল বা জরায়ুর ক্যানসার-সহ বিভিন্ন সমস্যার প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বাচ্চারা মাইক হাতে নিয়ে তাদের নিজেদের সমস্যার কথা নিজেরাই জানায় এবং উত্তর জানতে চায়।
প্রতি শনিবার স্কুলে বাচ্চারা ব্যাগ ছাড়াই আসে। ওই দিন নাটক, নাচ, গান, ছবি আঁকা, বিতর্ক, গাছ লাগানো, আবৃত্তি, ক্যারাটে সহ নানা সৃষ্টিশীল কাজের মধ্য দিয়ে তাঁদের অন্তরসত্তার বিকাশে চেষ্টা করা হয়। আমরা বিশ্বাস করি, কোথাও না কোথাও শুদ্ধস্বরের প্রভাব পড়ে, পড়বে। আজ নয় তো কাল। তাই সবটাই ফাঁকি নয়। সমুদ্রে ছোট ছোট ঢেউ না থাকলে বড় ঢেউ জন্ম নিতে পারে না। তাই নারী দিবস যেন লিঙ্গ খাঁচায় বন্দি না হয়। ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডের নিগড় ভেঙে রোজের দৈনন্দিন জীবনে ‘নারী দিবস’ উদ্যাপিত হোক, এই আশাই রাখি আগামীর কাছে।
(লেখিকা হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের প্রধান শিক্ষিকা)