পাত্র আইটি ইঞ্জিনিয়ার, সুদর্শন, বয়স ৩৬, মধ্য কলকাতায় নিজস্ব বাড়ি, দাবিহীন। অনুর্ধ্ব ২৫, সুশ্রী, স্নাতকোত্তর, কর্মরতা পাত্রী চাই।
পাত্রী বিএড, ফর্সা, বয়স ২৪, কলকাতা নিবাসী সরকারি চাকুরে, দাবিহীন অনুর্ধ্ব ৩২ পাত্র চাই।
পাত্র মুম্বইয়ে কর্মরত, সুদর্শন, বয়স ৩৯। অনুর্ধ্ব ২৮, সুশ্রী, স্নাতকোত্তর, কর্মরতা পাত্রী চাই।
প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় করে রবিবারের ‘পাত্র চাই পাত্রী চাই’ পাতায় এমন লক্ষ লক্ষ বিজ্ঞাপন, বিজ্ঞাপন থেকে সম্পর্ক রোজ তৈরি হচ্ছে। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই নজরে আসবে এই সমস্ত বিজ্ঞাপনে পাত্রপাত্রী নির্বিশেষে একটি নির্দিষ্ট বয়সের অদ্ভুত চাহিদা আছে। ‘মেয়ের বিয়ের বয়স’ এবং সঠিক সময়ে ছেলের চাকরির মাঝখানে আটকে থাকা বাবা-মায়ের চিন্তার ছবিটা, বস্তুত শহরতলি ছাপিয়ে কলকাতাতেও খানিক একই রকম।
২০১১ সালের সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতা শহরে ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সের মধ্যে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার প্রবণতা সব থেকে বেশি। যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই বয়সসীমা সব সময়েই ৩৫ এর উর্ধ্বে। চমকপ্রদ তথ্য এই যে, কলকাতা শহরে বিবাহিত পুরুষদের ৭০ শতাংশেরই বয়স ৩৫-এর বেশি। ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী বিবাহিত পুরুষদের তালিকায় রয়েছেন মাত্র ২৮ শতাংশ। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে, এই খাস কলকাতা শহরেই, প্রতি এক জন বিবাহিত পুরুষ পিছু বিবাহিত নারীর সংখ্যা ৩। বিয়ের নির্দিষ্ট বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই অনুপাতও বাড়ছে, বলাই বাহুল্য। ২০১৫-তে পৌঁছেও সামাজিক চিত্রটা কিন্তু বিশেষ বদলায়নি।
সেন্সাস বলছে
৭০ শতাংশ বিবাহিত মানুষের বয়স ৩৫-এর উর্ধ্বে ২৮ শতাংশ রয়েছে ২০-২৯ বছরের মধ্যে ২০-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রতি এক জন বিবাহিত পুরুষ পিছু নারীর সংখ্যা তিন ৩৫-৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে বিবাহিত পুরুষের সংখ্যা নারীর তুলনায় বেশি।
ফার্মাসিউটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তন্ময়ের সঙ্গে প্রতিনিয়তই পরিবারের অশান্তি। কর্মসূত্রে প্রায়শই রাজ্যের বাইরে কাটাতে হয়। তন্ময়ের কথায়, “বাড়ির সঙ্গে প্রায়ই তাড়াতাড়ি বিয়ে করা নিয়ে ঝামেলা হয়। ওঁদের চিন্তা স্বাভাবিক, কিন্তু নিজের কাজে ঠিকমতো থিতু হতে বেশ সময় লাগে, কাজটাও কঠিন। এটাই আসল সময়। বিয়ের জন্য এই মুহূর্তে তাড়াহুড়ো না করলেও চলবে।”
এটা একটা উদাহরণ মাত্র। তন্ময়ের মতোই শহরের একটা বড় অংশের পুরুষদের ক্ষেত্রে বিয়ের বয়সের সংজ্ঞা পাল্টাচ্ছে দ্রুত। ছেলেদের চাকরি করে থিতু হওয়া আর স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় শেষের পরই মেয়ের জন্য সুযোগ্য ছেলের সন্ধানের মাঝে দু’পক্ষের বয়সের একটা প্রকট ব্যবধান চোখে পড়ছে।
সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতে, প্রথাটা চিরাচরিত। শীর্ষেন্দুবাবু জানান, “এই রীতিটা পালটে গেলে দারুণ ব্যাপার হতো। কিন্তু তেমনটা তো হল না। এখনও মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার গোঁড়ামিটা রয়েই গিয়েছে। ছেলেদের কিন্তু স্বনির্ভরতার জন্য অনেকটা বেশি সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়। শহুরে মানসিকতার সঙ্গে বিষয়টা একেবারেই খাপ খায় না।”
বয়স বিবাহিত পুরুষ বিবাহিত নারী
২০-২৪ ৩৫,৪৬৮ ৯২,১৭৭
২৫-২৯ ৯১,৩৪১ ১,৪৭,৫৯৩
৩০-৩৪ ১,৩৬,৩৬৪ ১,৫৫,৮৩০
৩৫-৩৯ ১,৬১,৯৬১ ১,৬৪,৬৩৭
৪০-৪৪ ১,৬১,৬২৫ ১,৩৭,০৭৩
৪৫-৪৯ ১,৫১,৯০৮ ১,২৩,৮৪৬
অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের কথায়: “আমার মতে, বিয়ে করার আগে ছেলেদের ক্ষেত্রে চাকরি করে স্বনির্ভর হওয়াটা বাধ্যতামূলক, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে ‘বিয়ের বয়স’টাই সব থেকে প্রধান হয়ে ওঠে।” সুচিতবাবু জানান, মেয়েদের মধ্যে একটু বেশি বয়সে বিয়ে বা কর্মসংস্থানের চেষ্টা, এটা সাধারণত মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই দেখা যায়। যদিও কলকাতার ক্ষেত্রে এখনও এই রীতি ততটা প্রচলিত নয়।অন্য দিকে, জনসংখ্যা তত্ত্ব নিয়ে গবেষণাকারী অর্থনীতিবিদ সুচিত হালদার বিষয়টিকে অন্য ভাবে ব্যখ্যা করেছেন। তাঁর মতে, “মহিলাদের ক্ষেত্রে সন্তান উত্পাদনের সময়কালটা ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পুরুষের ক্ষেত্রে বিষয়টা পৃথক। আমাদের মধ্যেকার পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতাই মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার পিছনে বড় কারণ, সেন্সাস রিপোর্টও সেটাই প্রমাণ করছে। ”
কর্মসূত্রে অন্য শহরে বা বিদেশে ভ্রমণও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অভিরূপবাবু বলেন, কর্মসূত্রে বাইরে যাওয়া পুরুষদের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হয়ে বিয়ে করার জন্য একটা বেশ বড় সময় দাবি করে, কিন্তু সেই সংখ্যাটাই বা কত? অভিরূপবাবুর সঙ্গে সুচিতবাবু এ ক্ষেত্রে সহমত। তাঁর মতে, “এটা অবশ্যই একটা বড় কারণ, কিন্তু পুরুষ এবং মহিলার ক্ষেত্রে বিয়ের পৃথক বয়সটাই এখানে অন্য সব কারণের উর্ধ্বে।” এই পার্থক্য এবং পুরনো ধারণাগুলোই আমাদের মানসিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এই ২০১৫-য় উত্তর আধুনিক একটা সমাজে পৌঁছেও এই বিভাজন, বস্তুত, সেই মানসিকতারই সাক্ষ্য বহন করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy