চলতি বছরের ৯ জুলাই সেনা অভিযানে ধ্বংসস্তূপে পরিণত উত্তর ওয়াজিরিস্তানের মিরানশাহ শহরের এই তালিবানি ডেরা। অভিযোগ, এর প্রতিশোধেই পেশোয়ারের সেনা স্কুলে মঙ্গলবার তালিবানি হামলা হয়। ছবি: রয়টার্স।
পেশোয়ারের স্কুলে মঙ্গলবার তালিবানি জঙ্গিদের শিশুমেধ যজ্ঞের পরে ফের বিশ্বজোড়া নজরের কেন্দ্রে আফগানিস্তান সীমান্ত ঘেঁষা পাকিস্তানের এই অঞ্চল।
বস্তুত, ভৌগোলিক কারণেই পেশোয়ার দীর্ঘ দিন ধরে জঙ্গিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। তবে পেশোয়ারে জঙ্গি বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের শুরু সেই আশির দশকে, আফগানিস্তানে দখল যখন সোভিয়েতের হাতে।
সোভিয়েত রাশিয়া আফগানিস্তানে সেনা পাঠিয়ে তৎকালীন বামপন্থী সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে চায়। আফগানিস্তান জুড়ে এর প্রতিবাদে সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। শুরু হয় রুশ দমনও। লক্ষ লক্ষ আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে আশ্রয় নিতে শুরু করেন। পেশোয়ার ছিল এই শরণার্থীদের অন্যতম আশ্রয় কেন্দ্র। এ নিয়ে সেখানকার ভূমিপুত্র পাকিস্তানিদের সঙ্গে শরণার্থীদের নানা সময়ে সংঘাতও বেঁধেছে।
আফগানিস্তানে রুশ উপস্থিতিতে অশনি সঙ্কেত দেখে আমেরিকা। ফলে গোপনে আফগান বিদ্রোহী মুজাহিদিনদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য শুরু করে তারা। সেই গোপন ‘অপারেশন’-এর অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই পেশোয়ার। সেই ‘অপারেশন’-এ পাক গুপ্তচর সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টালিজেন্স (আইএসআই) অন্যতম সহযোগী। মুজাহিদিনদের নানা শাখার নেতারা মূলত পেশোয়ারেই থাকতেন। সেই সময়ে পেশোয়ারে ঘাঁটি বানান ওসামা বিন লাদেনও।
রুশ সেনাবাহিনী আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পরে সেখানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সেই সময়েও পাকিস্তান থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য পেতে বিভিন্ন আফগান গোষ্ঠীর নেতারা পেশোয়ারে আসতেন। ওসামা বিন লাদেন-এর হাতে আল-কায়দার জন্ম এই শহরেই বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তার পরে আল-কায়দার কর্মকাণ্ডের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে ওঠে পেশোয়ার। নানা সময়ে ওসামা বিন লাদেন-সহ আল কায়দার শীর্ষ নেতৃত্ব এই শহরে এসেছেন, থেকেছেন। আসলে আফগানিস্তান সীমান্ত কাছাকাছি থাকায় এখান থেকে সহজেই আফগানিস্তানে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ও হামলা চালানো সম্ভব। বিপদে পড়লে সহজেই আফগানিস্তানে ঢুকে পড়া যায়। পাশাপাশি, আরবের বিভিন্ন দেশ থেকে আফগানিস্তান হয়ে নিরাপত্তা কর্মীদের চোখ এড়িয়ে সহজে পেশোয়ার আসা যায়।
৯/১১-র পরে আমেরিকা এই শহরের দিকে বিশেষ নজর দেয়। কারণ, পেশোয়ার তখন আল-কায়দা নেতাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। আমেরিকার চাপে আল-কায়দার উপরে কড়া হতে শুরু করে পাক-প্রশাসন। নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে তাঁদের চলাফেরা। বেশ কয়েক জন আল-কায়দা নেতা এই শহর থেকে ধরাও পড়েছেন। তবে এই তালিকার প্রথম দিকে নাম থাকবে আবু আহমেদ আল-কুয়েতির। যাঁর আসল নাম ইব্রাহিম সৈয়দ আহমেদ। আল-কায়দার শীর্ষ নেতৃত্ব না হলেও মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) ২০০৭ নাগাদ নিশ্চিত হয় যে ইব্রাহিমই আত্মগোপনকারী ওসামা বিন লাদেন-এর সঙ্গে বাইরের পৃথিবীর যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। সেইমতো তাঁর ফোনে আড়ি পেতে জানা যায় তিনি পেশোয়ারেই থাকেন। দীর্ঘ দিনের চেষ্টায় সিআইএ-র একটি দল পেশোয়ারে তাঁকে চিহ্নিত করতে পারে। তাঁর গতিবিধির উপর নজরদারি চালিয়ে অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের গোপন আবাসের সন্ধান মেলে। বাকিটা ইতিহাস।
আফগানিস্তানে তালিবানের পতনের পরেও পেশোয়ারে নানা ইসলামি জঙ্গি সংগঠনের কেন্দ্র ছিল। এই সময়েই পাকিস্তানি তালিবান তেহরিক-ই-তালিবান-এর উত্থান। আগের মতো এ বারেও তারা পেশোয়ারকে বেছে নেয়। এর মধ্যে ছোটখাটো জঙ্গি হামলারও শিকার হয়েছে পেশোয়ার। শুধু এ বছরেই সব মিলিয়ে প্রায় ১৫৮টি সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে পেশোয়ারে। এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সেনা স্কুলে এ দিন তেহরিক-ই-তালিবান-এর হামলা।
পেশোয়ারে তালিবানি সন্ত্রাসের খতিয়ান
• ২৮ অক্টোবর ২০০৯: পেশোয়ারে বাজারে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত ১৩৭, আহত প্রায় ২০০।
• ১৫ ডিসেম্বর ২০১২: পেশোয়ারের বাচা খান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হামলা। হত নয়।
• ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৩: পেশোয়ারে ‘অল সেন্টস চার্চ’-এ জোড়া আত্মঘাতী হামলায় নিহত ১২৭, আহত প্রায় ২৫০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy